আত্মসমর্পণের এক জ্বলন্ত শিক্ষা – GalachipaProtidin.Com
আত্মসমর্পণের এক জ্বলন্ত শিক্ষা – GalachipaProtidin.Com


বছর ঘুরে আমাদের মধ্যে আবারো ফিরে আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। সারা বিশ্বে মুসলমানরা হিজরি বর্ষের দ্বাদশ মাস তথা জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদযাপন করে থাকেন। আরবের অনেক দেশে একে বড় ঈদ বা ঈদুল কোবরাও বলা হয়ে থাকে। অন্যান্য দেশেও এর নিজস্ব ভিন্ন নাম রয়েছে তবে এর অর্থ ও তাৎপর্য অভিন্ন।

মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশে হজরত ইবরাহিম আ: নিজ পুত্র হজরত ইসমাইল আ:-কে আল্লাহর জন্য কোরবানি করার ইচ্ছা ও ত্যাগের কারণে সারা বিশ্বের মুসলমানরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করে দেয়ার লক্ষ্যে পবিত্র হজের পরের দিন ঈদুল আজহা উদযাপন তথা পশু কোরবানি করে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আ:-এর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন এবং পুত্রের পরিবর্তে তাকে পশু কোরবানি করার নির্দেশ দেন (সূরা সাফফাত : ৩৭/১০৭)।
ঈদুল আজহার পরিচয় : শাব্দিক অর্থ-উর্দু, ফার্সি ও বাংলা ভাষায় ‘কোরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কোরবান’ শব্দের স্থলে ব্যবহৃত হয়। ‘কোরবান’ শব্দটি ‘কোরব’ মূল ধাতু থেকে নির্গত, যার অর্থ হচ্ছে নৈকট্য। পারিভাষিক অর্থ-পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরয়ী তরিকায় নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়।

মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি : মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ:-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি (সূরা মায়িদাহ-২৭)। হাবিল ও কাবিলের কোরবানির ঘটনা পবিত্র কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতগুলোতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে (সূরা মায়িদাহ :২৭-৩১)।
কোরবানির ধারাবাহিকতা ও বাধ্যবাধকতা : কোরবানির ইতিহাস ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন মানবজাতির বা ধর্মের ইতিহাস। মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে- সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন’ (সূরা হাজ-৩৪)।

আমাদের কোরবানি সুন্নাতে ইবরাহিমি : আমাদের ওপর যে কোরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত হজরত ইবরাহিম আ: কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাইল আ:-কে আল্লাহর রাহে কোরবানি দেয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহিমি’ হিসেবে চালু হয়েছে। হজরত ইবরাহিম আ:-এর সেই মহত্ত্ব ও মাকবুল কোরবানিকে শাশ্বত রূপদানের জন্যই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা: এই দিনে মুসলমানদেরকে ঈদুল আজহা উপহার দিয়েছেন।

ইবরাহিম আ:-এর ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা: মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-কে মহান আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষা করেছেন। তিনি প্রত্যেকটি পরীক্ষায় পূর্ণ সফলকাম প্রমাণিত হয়েছেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তাঁকে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। (সূরা হাজ-৭৮) আল-কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে হজরত ইবরাহিম আ:-এর ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে (সূরা মুমতাহিনাহ-৪, সূরা সাফফাত : ৯৯-১০৯, সূরা আম্বিয়া-৬৯, ৭১, সূরা ইবরাহিম-৩৭)।
আল কুরআনে কোরবানির গুরুত্ব : ঈদুল আজহা তথা কোরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে যথেষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে (সূরা মায়িদাহ : ২৭, সূরা হাজ : ৩৪-৩৮; সূরা সাফফাত : ১০২-১১০; সূরা কাওসার-২, সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩)।

কাজেই কোরবানি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহিম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ সা: নিজে মদিনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবিরাও নিয়মিতভাবে করেছেন। অতঃপর অবারিত ধারায় মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।
ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য : ঈদুল আজহা হজরত ইবরাহিম আ:, বিবি হাজেরা আ: ও ইসমাইল আ:-এর পরম ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত উৎসব। তাই ঈদুল আজহার দিন পুরো মুসলিম জাতি পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। পশুর রক্ত আর গোশত যেমন আল্লাহর কাছে যায় না তেমনি গ্রহণযোগ্যতা পায় না এগুলোর কোরবানিও। মূলত আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জজবা সৃষ্টি করা, ইবরাহিম আ:-এর পুত্র কোরবানির ন্যায় ত্যাগ ও পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করাই ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য।

ঈদুল আজহার চিরায়ত শিক্ষা : মানুষ মহান আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহিম আ: আমাদের জন্য রেখে গেছেন। ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাব্বত সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি আত্মসমর্পিত হয়ে যাওয়া। স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্রের গভীর আত্মবিশ্বাস, অতলান্তিক ঈমানী প্রেরণা, আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা ও অবশেষে আল্লাহকে খুশি করার জন্য তাঁর হুকুম মোতাবেক জীবনের সর্বাধিক প্রিয় একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে জবাই করার কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ- এ সবই ছিল আল্লাহর প্রতি অটুট আনুগত্য, গভীর আল্লাহভীতি এবং নিজের তাওহিদ ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। ইবরাহিম আ: আল্লাহর হুকুমে পুত্র কোরবানি করার মধ্য দিয়ে মূলত পুত্রের মুহাব্বতকে কোরবানি করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চেয়ে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তাঁর আচরণে। ইবরাহিম আ:-এর কাছ থেকে আল্লাহ এটিই চেয়েছিলেন। আর এটিই হলো প্রকৃত তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।

হজরত ইবরাহিম আ: সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন, হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ ঘোষিত মানবজাতির ইমাম। তিনি মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় করো তোমাদের জন্য ইবরাহিম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে একটি উত্তম আদর্শ বিদ্যমান’ (সূরা মুমতাহিনা-৪)।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *