তরুণদের হাত ধরে বাংলাদেশ নতুনভাবে হাজির হচ্ছে বিশ্বদরবারে। সম্প্রতি নিজেদের কাজের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলাদেশের তরুণরা। ফোর্বস সাময়িকীর থার্টি আন্ডার থার্টি (এশিয়া) তালিকায় স্থান পাওয়া চার তরুণকে নিয়ে লিখেছেন আবদুল্লাহ আল তোফায়েল ও এনাম-উজ-জামান বিপুল
দীপ্ত সাহা
সহ-প্রতিষ্ঠাতা : অ্যাগ্রোশিফট
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকরাই যেন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও বঞ্চিত। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সহজ পরিবহনব্যবস্থা ও কৃষিপণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কার্যকর পদ্ধতির অভাবে একদিকে যেমন কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, তেমনি কমছে না ক্রেতা হয়রানি। এটি নিয়ে কাজ করছেন দীপ্ত সাহা ও তার প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রোশিফট টেকনোলজিস। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এশিয়া বিভাগের কনজিউমার টেকনোলজি শাখায় থার্টি আন্ডার থার্টি তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন তিনি। অ্যাগ্রোশিফট কাজ করে দেশের দুই নিম্নবিত্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি কৃষক ও শ্রমিক নিয়ে। একদিকে কৃষকরা যেমন তাদের পণ্য সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারছেন না, তেমনি পোশাকশ্রমিকরা স্বল্প আয় ও সময়ের অভাবে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছেন না। অ্যাগ্রোশিফট এই শ্রেণির মানুষের সমস্যার সমাধান করেছে। কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে পোশাকশ্রমিকদের ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে খুব সহজেই শ্রমিকরা যেমন খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করতে পারছেন, তেমনি কৃষকরাও রক্ষা পাচ্ছেন একাধিক মধ্যস্বত্বভোগীর হাত থেকে। দীপ্ত সাহা ২০২১ সালের শেষ দিকে অ্যাগ্রোশিফটের অন্য দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা কাজী বুলান্দ মুসাব্বির ও রামিজ হককে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। অ্যাগ্রোশিফট একটি কৃষিনির্ভর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ডিজিটাল মার্কেট-প্লেস তৈরি করেছে। কৃষি এবং কৃষক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারা উপলব্ধি করেন বাংলাদেশে বড় পরিমাণে কৃষিপণ্য কেনাবেচার জন্য আড়ত ছাড়া অন্য সুযোগ প্রায় নেই। তারা একই সঙ্গে লক্ষ করেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ভেতরে অনেক মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন। তারা ভাবলেন যদি কোনোভাবে কৃষকের সঙ্গে শ্রমিকের সংযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে উভয়েই উপকৃত হবেন।
অ্যাগ্রোশিফট একদিকে যেমন কৃষকের কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু পরিবহন ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে, তেমনি পোশাকশ্রমিকরা যেন স্বল্পব্যয়ে ও অল্প পরিশ্রমে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য সংগ্রহ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে পারেন। তাদের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের কৃষক ও শ্রমিক দুই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখে হাসি ফোটাচ্ছে। অ্যাগ্রোশিফটের বিশেষত্ব হচ্ছে, ভোক্তা তার কারখানার ভেতরে স্থাপিত কিওস্কে এসে অর্ডার করেন এবং ড্রপ অব পয়েন্ট থেকে পণ্য সংগ্রহ করেন। এতে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা যাওয়া ও তারা অপেক্ষাকৃত ভালো মানের খাদ্যপণ্য কোনার সুযোগ পাওয়ায় উদ্যোগটি কারখানা কর্তৃপক্ষ থেকেও উৎসাহিত পাচ্ছে।
ফোর্বসের মতো একটি আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনের তালিকায় স্থান করে নিতে পেরে এবং দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে ভীষণ আনন্দিত জানিয়ে দীপ্ত সাহা বলেন, কৃষক যেন ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারেন, ভোক্তা যেন বাজারের চেয়ে কম দামে পণ্য পান, সেই লক্ষ্যে যে কাজ শুরু করেছি তা আরও বড় পরিসরে করতে চাই। কারণ কৃষি ও কৃষক না বাঁচলে আমাদের নাগরিক সভ্যতার ভিত্তিই নড়বড়ে রয়ে যাবে। অ্যাগ্রোশিফট কৃষককে তার পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা দিতে চায়। আগাম চাহিদার ভিত্তিতে দাম নিশ্চিত করে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক চাষে কৃষক যেন লাভবান হন, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যেতে চাই।
আনোয়ার সায়েফ ও সারাবন তহুরা
প্রতিষ্ঠাতা : টার্টল ভেঞ্চার স্টুডিও
আনোয়ার সায়েফ ও সারাবন তহুরা নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে ব্যবসার চেষ্টা করেন। কিন্তু উপযুক্ত দিকনির্দেশনা, পরামর্শ ও অভিজ্ঞতার অভাবে তাদের সেসব উদ্যোগ সফল হয়নি। কথায় বলে জীবনের ধন কিছু যাবে না ফেলা। ঠেকে ঠেকে শেখা সেসব অভিজ্ঞতা আজ আনোয়ার সায়েফ ও সারাবন তহুরার মূলধন। নতুন উদ্যোক্তাদের সময়োপযোগী পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের স্টার্টআপকে বিনিয়োগ এনে দেওয়া, স্বচ্ছন্দে পরিচালনা করতে সহযোগিতা করার জন্যই তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন টার্টল ভেঞ্চার স্টুডিও। এ বছর ফোর্বস ম্যাগাজিনের থার্টি আন্ডার থার্টি তালিকার এশিয়া বিভাগে সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট শাখায় স্থান করে নিয়েছেন তারা।
আনোয়ার সায়েফ ও সারাবন তহুরা জানান, ‘২০১৬-১৭ আমাদের স্টার্টআপের প্ল্যান শুরু করি এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করি। শুরুর দিকে সঠিক গাইড লাইনের অভাবে আমরা স্টার্টআপগুলোতে ব্যর্থ হই। তারপর আমাদের ব্যবসার পলিসি পরিবর্তন হয়। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি বাংলাদেশ সরকারের প্রচুর সাপোর্ট থাকলেও, আমাদের সংস্কৃতি ও সোশ্যাল এক্সপেক্টেশন এবং পর্যাপ্ত ফান্ডিং স্টার্টআপ ব্যবসার জন্য বড় বাধা। নতুন উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার লক্ষ্যে আমরা আমাদের পরের স্টার্টআপটি শুরু করি। ২০১৮ সালে টার্টল ভেঞ্চার নামে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।’ তারা টার্টল ভেঞ্চার স্টুডিওর মাধ্যমে দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের তৈরি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে কাজ শুরু করেন। স্টার্টআপগুলোকে অর্থায়ন, পরামর্শ, কারিগরি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলোকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরতে সহযোগিতা করেন। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা ৯০ জনেরও বেশি উদ্যোক্তার সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই উদ্যোক্তারা তাদের স্টার্টআপের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ পেয়েছেন। নারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের বিশেষ কর্মসূচি, যা জীবন পরিবর্তন করেছে অনেক উদ্যোক্তার। সমাজে এই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা পেলেন ফোর্বসের এই তালিকায় স্থান। ফোর্বস ম্যাগাজিনে থার্টি আন্ডার থার্টি তালিকায় স্থান পেয়ে খুবই খুশি সায়েফ ও তহুরা। নতুনদের জন্য তাদের পরামর্শ হলো, ফোকাস ধরে রাখতে হবে অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। আর মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হবে। আপনি যদি ঢাকা শহরের এসি রুমে বসে স্টার্টআপ দাঁড় করাতে চান, তা সম্ভব নয়।
জাহ্নবী রহমান
সহ-প্রতিষ্ঠাতা : রিলাক্সি
জনপ্রিয় ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের তৈরি করা এশিয়ার ৩০ বছরের কম বয়সী উদ্যোক্তা ও সমাজ পরিবর্তনকারীর তালিকায় জায়গা পাওয়াদের একজন জাহ্নবী রহমান। তিনি রিলাক্সির সহ-প্রতিষ্ঠাতা। রিলাক্সি একটি মানসিক গ্রহণের ডিজিটাল প্ল্যাটফরম। এই অ্যাপটি এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজারবার ডাউনলোড হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় চার হাজারের বেশি মানুষ অ্যাপসটি ব্যবহার করে। সমাজে মানুষের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার জন্য জাহ্নবী ফোর্বসের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। অথচ এই জাহ্নবী নিজেই হয়ে পড়েছিলেন জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, হতাশ। আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছিলেন তিনি। বারবার মায়ের মুখ মনে করে সে যাত্রা নিজেকে নিরস্ত্র করেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের থার্টি আন্ডার থার্টি তালিকায় নিজের নাম দেখে জাহ্নবী ভীষণ আপ্লুত হলেও নিজের এই অর্জন উৎসর্গ করেছেন, মানসিক সেবার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের সবাইকে।
২০১৯ সাল থেকে নাইমুল হক জয়, সামিউল ইসলাম স্বপ্নিল ও জাহ্নবী রহমান একসঙ্গে কাজ করছেন। শুরুর দিকে তারা ১৮ বছরের কম বয়সী তরুণ-তরুণীদের নিয়ে গ্যামিফিকেশ (অনূর্ধ্ব ১৮ বয়সীদের সফট স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) শুরু করেন। ২০২১ সালে, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর তারা অনুভব করলেন, ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। ফলে তাদের বেশি সহযোগিতা দরকার। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অবহেলা লক্ষ করে তারা মানসিক স্বাস্থ্যসেবার এই প্ল্যাটফরমটি গড়ে তোলেন। ২০২২-এর জুলাইয়ে প্লে-স্টোরে তারা রিলাক্সি নামে অ্যাপসটি চালু করেন। এর মাধ্যমে মানুষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে ফ্রিতে যোগাযোগ করতে পারেন, যেকোনো সমস্যা শেয়ার করলে বিশেষজ্ঞরা তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের জন্য ফ্রি থেরাপি ও মেডিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়। তবে সেবাগ্রহীতার আগ্রহ ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে ভার্চুয়াল থেরাপির ব্যবস্থাও করে দেয় রিলাক্সি।
২০১১ সাল থেকে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বস ৩০ বছর বয়সের আগেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদানের জন্য ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকাটি প্রণয়ন করে আসছে। এ বছর দীপ্ত সাহা, আনোয়ার সায়েফ, সারাবন তহুরা ও জাহ্নবী রহমানসহ সাতজন বাংলাদেশি তরুণ এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই নতুন বাংলাদেশের নতুন প্রত্যয়ের অগ্রদূত। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশ প্রবেশ করছে স্বনির্ভরতার মর্যাদাপূর্ণ ভুবনে।
Source link