বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। যে কারণে চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে সে চায় সর্বোচ্চ শাস্তি। মৃত্যুদণ্ডকে সর্বোচ্চ শাস্তি মনে করার কারণেই মানুষ তাড়াতাড়ি প্রতিকার চায়। মৃত্যুদণ্ডে সে বহাল থাকে। সাধারণ মানুষ থেকে সব ধরনের মানুষ মৃত্যুদণ্ডকে সর্বোচ্চ শাস্তি মনে করার কারণেই মৃত্যুদণ্ড সবার কাছে গ্রহণযোগ্য দণ্ড।
গত ২৪ মে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির ২০২১ সালের জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতের সংখ্যা বেড়েছে ৬৮। সংস্থার হিসাবে, ভারতে গত বছর ১৪৪ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭৭। পাকিস্তানে গত বছর প্রাণদণ্ড হয়েছে অন্তত ১২৯ জনের, আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ২৯। এ ব্যাপারে চা বিক্রেতা রসুল করিম বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড না হলে মাইনষের শিক্ষা হয় না।’ সবাই জানতে পারলে অপরাধ থেকে বিরত থাকে।
কলেজ শিক্ষক শুভেন্দু চক্রবর্তীও মনে করেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া একই ধরনের অপরাধীরা বুঝে উঠতে পারে না তারা কতবড় শাস্তি করেছে তাই মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা জরুরি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নৃবিজ্ঞানী জোবায়দা নাসরিনের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে। দেখা যাচ্ছে আন্দোলন বা বড় ধরনের আওয়াজ না উঠলে বিচার প্রক্রিয়া খুব ধীরগতিতে চলে। সেটা গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা পর্যন্ত।’ বাংলাদেশে বেশ কটি গণ-আন্দোলনের সময় মানুষজনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ব্যাপক সমর্থনের চিত্র ফুটে উঠেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। বিশেষত কানাডায় দৃষ্টান্ত দিতে গেলে দেখা যাবে মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে তারা একদম ‘না’। কানাডার নাগরিক হোক বা আশ্রিত যে কেউ হোক, কানাডার বাইরে অন্য কোনো দেশেও যদি তার মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনা থাকে, কানাডা তাকে ফেরত দেবে না। অন্য দেশে কানাডীয় কেউ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে কানাডা রাষ্ট্রীয়ভাবে সাধারণ ক্ষমা চাওয়ার কূটনীতি চালিয়ে যেতেও আইনত বাধ্য। সেদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান একদম আলাদা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ সাজা হিসেবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশে বড় ধরনের কোনো অপরাধ সংগঠিত হলেই অপরাধীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের দাবি ওঠে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন বড় আকার নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছিল। মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে স্লোগানে মুখরিত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এমনকি সড়কে, প্লাকার্ডে আন্দোলনকারীরা এঁকেছিল ফাঁসির রজ্জু। এ ঘটনা ছাড়াও ধর্ম অবমাননাকারী থেকে শুরু করে, খাদ্যে ভেজালকারী, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালক সবার জন্য দাবি মৃত্যুদণ্ড।
বাংলাদেশে যখন মৃত্যুদণ্ডের দাবি জোরদার হচ্ছে বিশ্বের বহু দেশে তখন মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তি হিসেবে রহিত করা হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে বিশ্বের ১০৬টি দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে। এছাড়া আশিটিরও বেশি দেশ রয়েছে যেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও তার ব্যবহার নেই।
নুসরাত হত্যার রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষে বাংলাদেশে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কটি অত্যন্ত ইতিবাচক। সেই জন্য বিতর্কটি চলতে থাকা প্রয়োজন। আপাতত পক্ষে-বিপক্ষে ঢালাও বিতর্কটি চলছে। একদল বলছে ‘মৃত্যুদণ্ড থাকা দরকার’, অন্যদল বলছে ‘মৃত্যুদণ্ড রহিত হওয়া দরকার’। সবারই পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি আছে।
বলা বাহুল্য, মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে যুক্তিগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। যেমন পৃথিবীতে মাত্র ৫৬টি দেশে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। ১০৬টি দেশেই দণ্ডটি রহিত, ২৮টি দেশে কাগজে-কলমে উপস্থিতি থাকলেও প্রয়োগ নেই-ই বলা যায়। ইউরোপীয় কমিশনভুক্ত ৪৪টি দেশ মানবিক অধিকার কনভেনশনের ১৩ ধারায় স্বাক্ষর করেই মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে।
মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে আরও শক্তিশালী যুক্তি হচ্ছে, যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে সেগুলোতে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ অন্য সব দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ইউরোপের দেশগুলোতেও মৃত্যুদণ্ডপ্রথা রহিত। বিস্ময়ের বিষয় সেই সব দেশেও নৃশংসতার উদ্দেশ্য, ধরন ও মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে সীমিত আকারে, ব্যতিক্রম ও ‘দৃষ্টান্ত’ হিসেবে দু-একটি মৃত্যুদণ্ডের বিধান বলবৎ করা যায় কি না, সেই আলাপটি জোরালো হচ্ছে।
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায়ে ১৬ জন আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরে বিষয়টি আরও আলোচনায় এসেছে। সাধারণত অপরাধীর মনে ভীতি জাগিয়ে তোলার কায়দা হিসেবে সৌদি আরব, ইয়েমেনসহ কিছু আরব দেশ ও ইরানে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রীতি রয়েছে।এসব দেশে মৃত্যুদণ্ড প্রতিষ্ঠিত একটি শাস্তি।
কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের বিপরীত চিন্তায় ভাবা হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেই তো পরিস্থিতির শিকার। তারা বয়সে অপরিপক্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম ছিল কিংবা অন্য কোনো ছোটো অপরাধ ঢাকতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছেন। মৃত্যু হয়ে গেলে শোধরানোর কোনো পথই থাকলো না। সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কি একটি সমাজে অপরাধ কমাতে সাহায্য করে? অপরাধবিজ্ঞানী খন্দকার ফারজানা রহমান এ ব্যাপারে বলছেন, ‘এই বিষয়ে যত অ্যাকাডেমিক লিটারেচার আছে, সব ঘাটলে দেখা যাবে রি-অফেন্ডিং রেট, শাস্তির পরও আবার অপরাধ করার যে প্রবণতা সেটা কোনো দেশে কমানো যায়নি।’ বরং দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি, তার আত্মীয়স্বজনও এ ঘটনায় আরও ভয়ংকর হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডে অপরাধ প্রবণতা ও মানসিকতা বাড়ে বৈ কমে না। সুতরাং শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ভাবা দরকার।
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড-বিরোধী ক্যাম্পেইন করে এমন সংগঠনও খুব একটা নেই। বাংলাদেশ লিগাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র মাঝে মাঝে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী বলছেন, ভিন্ন ধরনের শাস্তি ও অপরাধীর সংশোধনমূলক ব্যবস্থার ধারণাটি জনপ্রিয় করে তোলার কথা। তিনি বলছেন, ‘আমরা তো ঔপনিবেশিক আইন অনুসরণ করছি, যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে যারা এই আইন করেছিল, সেই ব্রিটিশরাই কিন্তু এখন সেখান থেকে সরে গেছে। মৃত্যুদণ্ড এখন আর তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নয়।’ অন্যান্য রাষ্ট্র যদি মনে করতে পারে যে এটার দরকার নাই, অন্যভাবে এটার শাস্তি হতে পারে, একদিন আমরাও হয়তো ভাবতে পারি যে দেখি না অন্য রাষ্ট্রগুলো কীভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বা সংশোধনমূলক নিচ্ছে।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, ‘মৃত্যুদণ্ড রহিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়।’
মাণোবকোন্থ/এফআই
Source link