যেমন নিরো-মোদী, তেমন তাঁর মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল – TheWall
যেমন নিরো-মোদী, তেমন তাঁর মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল – TheWall

অমল সরকার

মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হিরণ্ময় নীরবতায় বোধহয় সম্রাট নিরোও লজ্জা পেতেন। জাতি দাঙ্গায় একশো বিশ-পঁচিশজনের প্রাণ যাওয়ার পরেও আত্মপ্রচারে চৌকিদার জাহির করা ভদ্রলোকের মুখে টুঁ শব্দটি নেই। ‘সবকা সাথ’ স্লোগানের কপিরাইটধারী প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই সবই তাঁর কাছে কৃষি আইন, এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মতো ‘ছোটখাটো’ ব্যাপার। গুজরাত দাঙ্গায় মণিপুরের কুড়ি গুণ বেশি মানুষের হতাহতের সাক্ষী থাকার বিরল অভিজ্ঞতার কারণেই কি একশো-সোয়া একশো মৃত্যু প্রধানমন্ত্রীকে তেমন বিচলিত করে না?

এমন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে থাকলে জাতিদাঙ্গায় এত মানুষের মৃত্যু এবং দু’মাস পরেও হিংসা থামাতে ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী যে লাজ-লজ্জা, নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে মহা-নাটক মঞ্চস্থ করার স্পর্ধা ধরবেন এটাও স্বাভাবিক। পদত্যাগের দাবি এড়ানোর এক নয়া কৌশল শনিবার ‘দু-কান কাটা’ রাজনীতিকদের জন্য হাজির করেছেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী। নিরাপত্তার কারণে যে মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে রক্ষীর বেষ্টনী মশা-মাছি পর্যন্ত ভেদ করতে পারে না, তাঁর কনভয় মহিলাদের ঘিরে ধরা, ঠিক পদত্যাগপত্রটিই কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা যে চিত্রনাট্য মেনে সংঘঠিত হয়েছে তা ঘটনা পরবর্তী বক্তব্যেই স্পষ্ট। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের পর মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং টুইটে বলেছেন, ‘জনগণের আস্থা ছাড়া কেউ নেতা হতে পারেন না। আমার ভাল লাগছে যে আমি (সিএম হাউস থেকে) বের হওয়ার পর রাস্তায় প্রচুর ভিড় ছিল। মানুষ কাঁদছিল এবং আমার প্রতি তাদের আস্থা জানাচ্ছিল। এটা আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। কারণ জনগণ এখনও আমার পাশে আছে। তারা আমাকে পদত্যাগ করতে না বলেছে। তারা আমাকে পদত্যাগ করতে বললে আমি দেব, যদি তারা আমাকে না বলে, আমি করব না।’

এমন হাতে-গরম দৃষ্টান্ত থাকতে তামিলনাড়ুর রাজ্যপালই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! চক্ষু-লজ্জার মাথা খেয়ে তিনিও চেয়ার আঁকড়ে আছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া রাজ্যের মন্ত্রীকে তাঁর বরখাস্ত করার নির্দেশ জারির নজিরবিহীন সিদ্ধান্তটির দায়িত্বশীল কোনও ব্যক্তি সমর্থন করেছেন বলে জানা যায়নি। দু’একটি ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যম তামিলনাড়ুর রাজ্যপালের সিদ্ধান্তের নিন্দায় মুখর হয়েছে। রাজ্যপাল এন রবি নিজেও ভুল বুঝতে পেরে নির্দেশটি কার্যকর না করতে ঘণ্টা পাঁচেকের ব্যবধানে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠান। জবাবে তামিলনাড়ুর সরকার বলেছে, রাজ্যপালের আগের নির্দেশটি তারা অগ্রাহ্য করছে।

রাজ্যপালের নির্দেশের এমন অবমাননাকর জবাব যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের পক্ষে কাম্য নয়। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালেরা সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন করে আধা সেনার কমান্ডারের মতো আচরণ করলে এমন প্রত্যুত্তর অপ্রত্যাশিত নয়। এমন অবমাননার পরেও অবসরপ্রাপ্ত এই পুলিশ কর্তা রাজ্যপালের পদ ছা়ডার বাসনা ব্যক্ত করেছেন বলে শোনা যায়নি।

তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল প্রথম নন। তাঁকে অপমান করেছেন, এই অভিযোগ এনে এক মন্ত্রীকে বরখাস্তের বাসনা ব্যক্ত করে গত বছর কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে চিঠি লিখেছিলেন। ওই রাজ্যের সিপিএম সরকারও সেই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে। কেরলের সেই রাজ্যপাল অবশ্য বহুদিন চুপচাপ। শোনা যাচ্ছে উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে জগদীপ ধনকড়ের কাছে হেরে গিয়ে চুপসে গিয়েছেন প্রাক্তন এই কংগ্রেসি।

বাংলার রাজ্যপাল হিসাবে রাজভবনকে কলুষিত করার আরও পুরষ্কার হিসাবে ধনকড়কে এরপর রাষ্ট্রপতি পদের জন্যও বিবেচনা করতে পারে বিজেপি। কিন্তু বাংলার মানুষ তাঁকে মনে রাখবে পুলিশ-রাজ্যপাল হিসাবে। রাজভবনকে তিনি বিজেপির থানায় পরিণত করেছিলেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও তাঁকে কম অসম্মান, অপমান করেনি। বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলিতে বিজেপির রাজ্যপালদের হয়তো এই ব্যবহার পাওয়াই দস্তুর। অন্যদিকে, তাঁদেরও সবচেয়ে বড় যোগ্যতা এটাই, শত অপমানেও তাঁরা রাজভবন ছেড়ে যাবেন না। মহারাষ্ট্রের আগের রাজ্যপাল ভগৎ কোশিয়ারি সুপ্রিম কোর্টের শুনানির গতিপ্রকৃতি দেখে সম্ভবত বুঝেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত তাঁর মুখে ঝামা ঘষে দেবে। তাই আগেভাগে সরে গিয়েছিলেন। ইনি সেই রাজ্যপাল বিজেপিকে ক্ষমতায় বসাতে গোপনে সূর্যাস্তের আগে রাজভবনে শপথের আয়োজন করেছিলেন।

রাজ্যপালেরা অবশ্য কোনও কালেই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। তবে মোদী জমানার মতো আধা সেনার কমান্ডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি অতীতের কোনও রাজ্যপাল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ঘেরাও মুক্ত করতে ধনকড়ের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাওয়া, তামিলনাড়ু ও কেরলের রাজ্যপালদের মন্ত্রীকে বরখাস্তের সুপারিশ, তেলেঙ্গানার রাজ্যপালের বিধানসভায় পাশ হওয়া গুচ্ছ বিল আটকে দেওয়া, পাঞ্জাবের রাজ্যপালের বাজেট অধিবেশন ডাকতে অস্বীকার করা থেকে মনে হয় বিরোধী দল শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালদের জন্য ‘ধনকড় গোল্ড কাপ’ চালু আছে।

মোদীর প্রসঙ্গে ফিরি। বিজেপি দাবি করে, তিনি গত পাঁচ-ছয় বছরে ৪৭ বার উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে গিয়েছেন। বিজেপির প্রথমসারির নেতারাও বলতে গেলে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন ‘নর্থ ইস্ট অভি দিল্লি সে দূর নহি, দিল সে ভি নহি।’ মোদ্দা কথা উত্তর-পূর্ব আর রাজধানী দিল্লির মধ্যে ভৌগোলিক ও মনের দূরত্ব ঘুচে গিয়েছে।

মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির সাফল্য সত্যি অস্বীকার করার নয়। ২০১৬-র আগে উত্তর-পূর্বে একটি রাজ্যেও পদ্ম-শিবির ক্ষমতায় ছিল না। মোদী-শাহের জমানায় দল ভাঙানোর খেলা এবং লাগাতার প্রচারে উত্তর-পূর্বের ছ’টি রাজ্যে পায়ের নীচে মাটি অনেকটাই শক্ত করেছে পদ্ম শিবিরের। বলাই যায়, বিজেপির উত্তর-পূর্ব বিজয়ের কৃতিত্ব ষোলো আনাই মোদীর।

বিজেপি ক্ষমতায় থাকা সেই ছয় রাজ্যের একটি মণিপুর জ্বলছে। আজ রবিবার পূর্ণ হল অশান্তির দু’মাস। চলতি অশান্তির মূলে উত্তর-পূর্বের আদি সমস্যা জাতিগত বিবাদ। ডবল ইঞ্জিনের সরকারের সময় সেই সমস্যার সমাধান দূরে থাক, আরও চেগে উঠেছে।

জাতি দাঙ্গার শুরুতে মণিপুর যখন হত্যালীলায় মেতে, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন কর্নাটকে ভোটের প্রচারে ব্যস্ত। টিভির পর্দায়, খবরের কাগজের পাতায় দেখা গিয়েছে একদিকে মণিপুরের অসহায় মানুষ প্রাণের তাগিদে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালাচ্ছেন, অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী কর্নাটকের সভামঞ্চে, রোড শো’য়ে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। জনতার ‘মোদী’ ‘মোদী’ স্লোগানে মণিপুরের মানুষের কান্না প্রধানমন্ত্রীর কানে নাই পৌঁছতে পারে।

মনে করা হয়েছিল কর্নাটকের প্রচার-পর্ব মিটলে সেখান থেকেই প্রধানমন্ত্রীর বিমান ইম্ফলের দিকে রওনা হবে। লোকসভা ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী সকালে অরুণাচল দিয়ে শুরু করে দুপুরে বারাণসী হয়ে সন্ধ্যায় আরও কোনও রাজ্যে সভা করে রাতে দিল্লি ফিরেছেন।

সেই প্রধানমন্ত্রী দূরে থাক, তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মণিপুরের মৃত্যু উপত্যকায় গিয়েছেন হিংসা শুরুর ২৬ দিনের মাথায়। প্রধানমন্ত্রীর যদিও ব্যস্ততার শেষ নেই। কর্নাটকের ভোট পর্ব মিটিয়েই ছুটেছেন অস্ট্রেলিয়া, জাপানে। ফিরে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে। সেই পর্ব মিটতেই প্রস্তুতি শুরু করতে হয়েছে মার্কিন সফরের। প্রধানমন্ত্রী দেশের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে শোক পালন, মণিপুরে শান্তি ফেরাতে না পারায় মন খারাপ করা, হিংসা বন্ধে আর্জি জানানোর সময় কোথায়! আর প্রধানমন্ত্রী যখন ব্যস্ততার কারণে মণিপুর নিয়ে ভাবার সময় নেই তখন মুখ্যমন্ত্রীই কোন আক্কেলে পদত্যাগ করতে যাবেন! তাঁরই বা রাজধর্ম পালনের কী দায় পড়েছে। গুজরাত দাঙ্গায় যে কথাটি অটল বিহারী বাজপেয়ী তাঁর অনুজ দলীয় সতীর্থকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই অনুজ সহকর্মীরই বা দোষ কী! গুজরাতের দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করার পর মণিপুর কেন, হিংসার আরও অনেক ভয়ানক রূপ বিবেককে স্পর্শ না করা অসম্ভব নয়।

খড়্গ হাতে রাজনীতি, মরছে কারা?


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *