ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ওপর বর্তমান হামলাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এসব ঘটনা বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস, ডেনমার্কে চার্লিহেবডোর নবী করিম সা:-এর ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন, ফিনল্যান্ডে পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ানোর ঘটনা, ইসরাইলের আল আকসা মসজিদ ও ফিলিস্তিনের ওপর আক্রমণ, ভারতে নূপুর শর্মার মুহম্মদ সা:-কে কটূক্তি, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের নীরবতা ও পরবর্তীতে মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমে বিবর্তনবাদ ও ইসলামী সংস্কৃতি পর্দা-প্রথা বিরোধী বিষয়বস্তু সংযোজন- এ সব কিছুই এক সূত্রে গাঁথা। এর পেছনে আছে শিশুদের কচি মনে ইসলামী মূল্যবোধের বিপরীতে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বা অন্য কোনো বিজাতীয় সংস্কৃতির বীজ বপনের সুগভীর দুরভিসন্ধি।
বর্তমান বিশ্ব-পরিসরে দৃশ্যমান দ্বন্দ্ব তিনটি-
১. বিশ্বের বাজার ও সম্পদ লুণ্ঠনে করপোরেট পুঁজির মধ্যকার দ্বন্দ্ব যুদ্ধ-বিগ্রহ ও পারস্পরিক হানাহানির মধ্যদিয়ে যার প্রকাশ ঘটছে।
২. বিভিন্ন ধর্মীয় মূল্যবোধের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। খ্রিষ্টান, ইহুদি ও হিন্দু উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সাথে করপোরেট প্রভুদের বিশ্ব-পরিসরে এক মুসলিমবিরোধী আঁতাত গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে ইহুদিবাদীদের সাথে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী ষড়যন্ত্র ভারত, বাংলাদেশে একেবারে নগ্ন আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী আগ্রাসন সেই ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি।
৩. ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে বস্তুবাদী করপোরেট সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ ইসলামী বিশ্ব-ব্যবস্থার সাথে বস্তুবাদী করপোরেট বিশ্ব-ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব।
বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থায় সবচেয়ে লক্ষণীয় দ্বন্দ্ব হলো ইসলামের তৌহিদবাদী বিশ্ব-দৃষ্টির সাথে পাশ্চাত্যের বহুত্ববাদী বা বস্তুবাদী বিশ্ব-দৃষ্টির মধ্যকার দ্বন্দ্ব। বর্তমান সময়ে এই দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে প্রধান দ্বন্দ্বে রূপ নিচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীব্যাপী অস্থির ভূ-রাজনীতি সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
এ (মূর্খ) লোকেরা তাদের মুখের (এক) ফুৎকারে মহান আল্লাহর (দ্বীনের) মশাল নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ পাক তাঁর এ আলোর পূর্ণ বিকাশ ব্যতীত অন্য। কিছুই চান না, যদিও কাফেরদের নিকট এটি খুবই অপ্রীতিকর। (আয়াত-১০:৩২)
আমি এভাবে একদল অত্যাচারীকে তাদেরই (অন্যায়) কার্যকলাপের দরুন আরেক দল অত্যাচারীর ওপর ক্ষমতবান করে দিই। (আয়াত-৬ : ১২৯)
ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-রাজনীতি ও সংস্কৃতি ভেদে বিভিন্ন এই দ্বন্দ্বের প্রকাশেও ভিন্নতা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বৃহৎ ও সম্প্রসারণবাদী শক্তি কর্তৃক দুর্বল দেশের ওপর রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের রূপ নিয়েছে। কোনো দেশ বা জাতির ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী করার প্রাথমিক শর্তই হলো সেই দেশ বা জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতিও ধর্মীয় মূল্যবোধের ধ্বংস-সাধন। বাংলাদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী প্রবণতা ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ সেই আগ্রাসনেরই ফলশ্রুতি।
আজ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ইমানের দুর্বলতা হেতু ইসলামবিরোধী সুবিধাবাদী প্রবণতা অনৈক্য শিকড় গেড়ে বসেছে। আর ইসলামের শত্রুরা সেই সুযোগটাই গ্রহণ করছে। সমগ্র পাশ্চাত্য জগত ও তথাকথিত গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা আজ ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। তাদের এই সর্বাত্মক বিরোধিতাই প্রমাণ করে যে ইসলাম অপরিমেয় শক্তির উৎস হিসাবে ইসলাম আজও তার শত্রুদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে। এই একুশ শতকে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর হামলা তাদের শতাব্দীব্যাপী ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলছে। সারা পৃথিবী জোড়া অত্যাচারী শাসক ও শোষক শ্রেণীর মিথ্যাচার ও ভণ্ডামির মুখোশ খসে পড়ছে।
ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত জ্ঞান মানবজাতির অতীতকে বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু আজকের বিশ্বে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো মানুষের ক্রমবিকাশের ভবিষ্যৎ গতিধারা অনুধাবন করা। আর আল্লাহর সৃজনশীল ক্রমবিকাশের গতিধারা নির্ণয় ও জানা-বুঝার ক্ষেত্রে আল-কুরআনের বিকল্প নেই।
কুরআন ও বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার মাধ্যমেই কেবল আল-কুরআনের সৃজনশীল অনুশীলন সম্ভব। আল্লাহর সৃষ্টি-রহস্য, নিদর্শনগুলোর বৈচিত্র্য, বিশ্ব-জগত ও মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এসব কিছু কুরআন অনুশীলন ও গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
২. ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম-নিরপেক্ষতা
একজন মুসলমানের জীবন সার্বিকভাবে কুরআনের অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনসহ তার ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় ধর্মীয় মূল্যবোধের বাইরে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সে ধরনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে আল-কুরআন সুস্পষ্টভাবে অজ্ঞানতা বা ‘জাহিলিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে আল-কুরআন তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ ধারণাটিকে বস্তুবাদ বা নাস্তিক্যবাদের সম্প্রসারণ বলেই মনে করে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিপরীতে জনগণের তথাকথিত সার্বভৌমত্বের ধারণা আসলে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও শ্রেণীগত স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষ ব্যক্তি বা সমষ্টিগতভাবে কখনো সার্বভৌম হতে পারে না। সে পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনস্থ প্রতিনিধি মাত্র। বিশ্বজগত ও মানুষ যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন তার সমগ্র সৃষ্টি-প্রক্রিয়া আল্লাহর ইচ্ছা, তাঁর সর্বব্যাপী জ্ঞান ও সার্বভৌমত্বের অধীনেই সঙ্ঘটিত হয়েছে। সুতরাং ডারউইনের বিবর্তনবাদ সেই সত্যকেই মানুষের সামনে তুলে ধরবে তার বাইরে কিছু নয়।
বাগানে বিষাক্ত ফলের বীজ বপন করে তা থেকে সুস্বাদু ফল আশা করা আর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিক্যবাদী আবহে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখা-নিছক নির্বুদ্ধিতা নয় কি?
একজন ঈমানদার মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব হলো এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো উৎখাত করে ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের লড়াইয়ে শামিল হওয়া। ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করা।
যারা মাধ্যমিক স্কুলের পাঠক্রমে বিশেষ করে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিবিরোধী বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাদের লক্ষও উদ্দেশ্য কি সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করতে হবে। শিশুদের পাঠক্রমে বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষও উদ্দেশ্য যে মহৎ নয় সেটি বলাই বাহুল্য। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও দলীয় স্বার্থে ইসলামী মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়া, মুসলিম সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নারী-জাতির পর্দা প্রথা নিয়ে উপহাস করার লক্ষ্য যে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ ক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের স্বার্থ রক্ষাকল্পে বিজাতীয় সংস্কৃতি আমদানি করতে ইসলামী মূল্যবোধকে বিনিময় মূল্য হিসেবে ব্যবহার করেছে। আর এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে আড়াল করার জন্য ডারউইনের বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। তারা হীন রাজনৈতিক স্বার্থে বিজ্ঞানকে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানোর প্রয়াস পেয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ইসলামী সংস্কৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা এবং প্রতিবাদের মুখে দুই পা এগিয়ে এক পা পিছিয়ে যাওয়া- এ সব কিছুই এক সুচতুর ষড়যন্ত্রের অংশ এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কায়েমি স্বার্থবাদীরা আবার আক্রমণ করবে- অতএব আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোকে, ভূ-রাজনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলিষ্ঠ ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দেশ ও জাতি বিশেষ করে তৌহিদি জনতাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এসব বিচার বিবেচনা করেই ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্ম-কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
জাতীয় শিক্ষা-নীতিতে কুরআন ও বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানীদের ঐতিহাসিক অবদানকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
Source link