তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না

গাজীপুরের কালীগঞ্জের মোক্তারপুর গ্রামের গৃহিণী মরিয়ম বেগম। স্বামী কৃষক, মাঠের কাজেই দিন পার হয়। বাড়ির দিক সামলান মরিয়ম। শুধু যে ঘর গোছানো বা রান্না-বান্নায় ব্যস্ত থাকেন তা নয়। কয়েকটি ছাগল পালেন, গরুও আছে, আছে হাঁস-মুরগিও। বাড়ির আঙিনায় সব ধরনের সবজির চাষও করেন মরিয়ম নিজেই। দুই সন্তান আর স্বামী নিয়ে অন্য আট-দশটা পরিবারের চেয়ে ঢের ভালো চলে তার সংসার। গরুর দুধ, ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে আর স্বামীর সামান্য আয়ে সংসার চলছে হরদম। বছরের অধিকাংশ সময় সংসার খরচের অর্থ স্বামীর চেয়ে তার পরিশ্রমেই বেশি আসে। শুধু মরিয়মই নন, দেশের যেখানেই নারীরা সংসার চালান সেখানেই দারিদ্র্য কমে।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সারা বিশে^ই প্রশংসিত। দেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার ফলাফলও ইতিবাচক। সরকারের জরিপই বলছে, নারীপ্রধান পরিবারে পুরুষপ্রধান পরিবারের চেয়ে দারিদ্র্য অনেক কম। অর্থাৎ দারিদ্র্য ঠেকানোর দিক থেকে এগিয়ে আছেন নারীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২-এর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে উচ্চ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে রয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার। উচ্চ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে থাকা নারীপ্রধান পরিবারগুলোতে দারিদ্র্যের হার ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, অথচ পুরুষপ্রধান পরিবারে দারিদ্র্যের হার ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ নারীর নেতৃত্বে থাকা পরিবারের দারিদ্র্যের হার পুরুষের নেতৃত্বে থাকা পরিবারের তুলনায় অনেক কম।

নিম্ন দারিদ্র্যসীমা বা হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে নারীপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। যেখানে একই ধরনের পুরুষপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

নারীপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্য কম হওয়ার কারণ হিসেবে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নারীপ্রধান যেসব পরিবারের কথা বলা হচ্ছে তাদের সংখ্যা খুব কম। পুরুষপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বেশি। সংখ্যা বেশি হওয়ায় পুরুষপ্রধান পরিবারের হার কম এসেছে।

আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, নারীদের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় কাজ করে। নারীরা স্বাভাবিকভাবে সঞ্চয়প্রবণ। তারা যেকোনো ক্ষেত্রে খুব হিসাব করে খরচ করেন। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতেই খরচ করেন। দ্বিতীয় বিষয় হলো, বিধবা নারীদের জন্য সরকারও সহায়তা করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে নারীরা দরিদ্র হিসেবেও প্রাধান্য পান, বিধবা হিসেবেও নারীরা প্রাধান্য পান। সব মিলিয়ে নারীপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্যের হার কমার বিষয়টি ইতিবাচক।

দেশে নারীপ্রধান পরিবারের উচ্চ দারিদ্র্যের হার কম থাকার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেখার বিষয় কোন পরিবারগুলো নারীপ্রধান পরিবার হয়। যে পরিবারগুলোর পুরুষ সদস্যরা অভিবাসী হয়েছেন সে ক্ষেত্রে নারীরা পরিবারের প্রধান হিসেবে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে যেসব পুরুষ স্থানান্তর (মাইগ্রেট) হয়েছেন তারা বিভিন্নভাবে পরিবারে টাকা পাঠান। এটা একটা কারণ। এ ছাড়া কোনো পরিবারের সম্পত্তি বা জমিজমা ব্যবস্থাপনা করছেন নারী। সেসব সম্পত্তি থেকে আসা আয় দিয়ে নারীরা সংসার নিয়ন্ত্রণ করেন।

তিনি বলেন, নারীপ্রধান পরিবারের নারীরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে থাকেন। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে তাদের পরিবার চালানো, ছোট ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়া এ ধরনের অনেক কাজে তারা নিয়োজিত হন। অর্থের ব্যবস্থাপনায় নারীরা খুব ভালো করে থাকেন। বিভিন্ন দেশে এমনকি বাংলাদেশেও বিভিন্ন গবেষণায় এ বিষয়টি উঠে এসেছে। কোনো পরিবারে নারীর হাতে যদি অর্থ থাকে, তিনি সেটিকে ব্যবসায় দিয়ে আরেকটু অর্থ বাড়িয়ে পরিবারের সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেন। নারীদের ক্ষেত্রে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও অর্থের ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বেশি। এ বিষয়গুলো চিন্তা করলেও নারীপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্য কমার কারণ হতে পারে।

জরিপ বলছে, শহরের তুলনায় গ্রামের নারীপ্রধান পরিবারের উচ্চ দারিদ্র্যের হার কিছুটা বেশি। গ্রামের নারীপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্যের হার ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে শহরের একই ধরনের পরিবারের উচ্চ দারিদ্র্যের হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্রামের তুলনায় শহরের নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। শহরের অনেক নারী নিজেরা চাকরি করেন আবার সংসারও দেখভাল করেন। এজন্য এ হার শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি।

সায়মা হক বলেন, শহরের খানাগুলোর (পরিবারে) যারা নারীপ্রধান সেসব ক্ষেত্রে নারীরা মোটামুটিভাবে মধ্য আয়ের বা চাকরিজীবী হতে পারেন। সার্বিকভাবে তাদের অবস্থা ভালো। গ্রামাঞ্চলে নারীপ্রধান পরিবারের কারণ হতে পারে প্রবাসী আয়, স্থানান্তর বা কিছু ক্ষেত্রে স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবাও হন। এগুলো গ্রামাঞ্চলেই বেশি। শহরাঞ্চলে তুলনামূলক এ হার কম। শহরে তুলনামূলক মধ্যবিত্ত পরিবার। এখানের নারীরা আয়-উপার্জনের সঙ্গে জড়িত।

তথ্য-বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, গত এক যুগে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে। ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালেও নারীপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্য কম ছিল। ওই সময় পুরুষপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্যের হার ছিল ৩২ দশমিক ১ শতাংশ, যেখানে নারীপ্রধান পরিবারের হার ছিল ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

এক যুগে দারিদ্র্যের হার কমা বা নারীপ্রধান পরিবারের দারিদ্র্য কমার কারণ হিসেবে অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, সার্বিকভাবে দারিদ্র্য কমার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ই অংশীদার। নারীপ্রধান খানাগুলোর বড় একটা অংশই রেমিট্যান্সনির্ভর খানা। যেহেতু রেমিট্যান্স পান নারীরা, সেহেতু তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থায় এক ধরনের পরিবর্তন হয়। অর্থ খরচের ক্ষেত্রে তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিনিয়োগে তারা বেশি খরচ করেন। তারা বিনিয়োগ করার কাজটি সঠিকভাবে করে থাকেন। অর্থাৎ একই টাকা যদি পুরুষও পান বা নারীও পান তখন নারীরা এসব ক্ষেত্রেই বেশি খরচ করেন।

তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে ক্ষুদ্র অর্থায়ন, এসএমই, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এগুলোর বড় পরিবর্তন হয়েছে। এ ব্যাপারগুলোই পুরুষের সঙ্গে নারীর পার্থক্য করার জন্য দায়ী।

দারিদ্র্যের গড়হার বর্তমানে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে উচ্চ দারিদ্র্যের গড়হার ছিল ২৪ শতাংশ।

নারীরা পরিবারের প্রধান হবেন বিষয়টি এখনো সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। তাই অনেক নারী পরিবারের কর্তা বা কর্ত্রী হিসেবে পরিচিতি পেতে চান না। ফলে নারী পরিচালিত পরিবারের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এবারের জরিপ বলছে, ২০২২ সালে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা কমেছে। ২০১৬ সালে নারীপ্রধান পরিবারের হার ছিল ১৩ দশমিক ১ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশে।

দেশে নারীপ্রধান খানার সংখ্যা কমে গেছে। অর্থাৎ যেসব পরিবার বা খানার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নারীরা নেন, এমন পরিবারের সংখ্যা কমেছে দেশে। তার বিপরীতে বেড়েছে পুরুষপ্রধান পরিবারের সংখ্যা । বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয়ভাবে এখন দেশে পুরুষপ্রধান পরিবার ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ। তার বিপরীতে নারীপ্রধান পরিবার ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৬ সালের জরিপে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে দেশে পুরুষপ্রধান পরিবার ছিল ৮৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর নারীপ্রধান পরিবার ছিল ১৩ দশমিক ১ শতাংশ।

বিবিএসের জরিপের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে নারীপ্রধান পরিবার বেশি। ২০২২ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে নারীপ্রধান পরিবার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এ ধরনের পরিবার ১২ দশমিক ২ শতাংশ। তবে উভয় ক্ষেত্রে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বা হার ২০১৬ সালের তুলনায় কমেছে। ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে নারীপ্রধান পরিবার ছিল ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ আর শহরাঞ্চলে এ ধরনের পরিবার ছিল ১২ দশমিক ৭ শতাংশ।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ১৯৯৫ সালের বেইজিং ঘোষণা এবং ২০১০ সালের জাতিসংঘের ২৩তম বিশেষ অধিবেশনের ফলাফল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দারিদ্র্যের হার কমার কারণ হিসেবে আরও অন্য বিষয়ের সঙ্গে সরকারের কিছু পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন জনসংখ্যা কাঠামো পরিবর্তন, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত ও টেলিযোগাযোগ সংযোগের উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ অভিবাসন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কর্মসূচি বৃদ্ধি।


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *