আহমদ ছফা একটি বরকতময় নাম। তাঁকে নিয়ে সত্য মিথ্যা যে যা বলে সকলে খায়। সকলে বলাটাও ঠিক হল না। অনেকে আহমদ ছফাকে এত কাছে থেকে জানেন চেনেন, তাদের কারও কারও এসব খেতে গিয়ে বদহজমেরও কারণ হয়। আহমদ ছফাকে নিয়ে যত রকম কাজ হয়েছে বা হচ্ছে তার কোনটি প্রাণ থেকে, কোনটি ধান্দাবাজি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না। কেউ কেউ আহমদ ছফাকে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে কিন্তু ভেতরে ভেতরে নোংরামিকে লালন করে, এ ধরনের একটি গোত্র রয়েছে।
আরেকটা গোত্র রয়েছে যারা স্রোতের বিপরীতে চলতে অভ্যস্ত। স্রোতের বিপরীতে চলা খারাপ কিছু নয়, কিন্তু এ স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষগুলোর স্বভাব হল আহমদ ছফার বাজে গন্ধ খোঁজা, তাঁকে গালমন্দ করা এবং পারলে তাঁকে এককথায় খারিজ করে দেওয়া, সেই সঙ্গে তারা একজন সৎ, খাঁটি এবং সবজান্তা হিসেবে নিজেকে অন্যের কাছে প্রতিষ্ঠা করা। তাদের কথা খুব বেশি মানুষে না খেলেও কেউ কেউ খায় এবং আহমদ ছফাকে তারা কবর থেকে তুলে এনে তাঁর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে। আর একটি চরিত্র রয়েছে যারা আহমদ ছফাকে বেচাবিক্রি করে আখের ঘোছায়। কেউ কেউ আহমদ ছফার ঘাড়ে পা রেখে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়, “আমাকে লহ করুণা করে।”
খুব কমই আছেন যারা অন্তর থেকে আহমদ ছফাকে নিয়ে কাজ করেন, চিন্তা করেন, নির্মোহ দৃষ্টিতে অন্যের কাছে তাঁকে তুলে ধরেন। বেশিরভাগই আহমদ ছফাকে যত না প্রচার করেন তার চে আত্মপ্রচার করেন বেশি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, কেউ কেউ আহমদ ছফাকে নিয়ে ঈর্ষায় ভোগেন। তাদের লেখা এবং কথাবার্তার ধরন মনে করিয়ে দেয় তারা আহমদ ছফার গুরু, তাদের কাছে আহমদ ছফা লেখালেখি শিখেছেন, অথবা আহমদ ছফা এমন কি লিখেছেন সেসব আকার ইঙ্গিতে বুঝানোর চেষ্টা করেন। মজার ব্যাপার হল, এসব গুণধররা আহমদ ছফার ডেরায় দিনমান বসে থেকে তাঁর অমৃত বচন শ্রবণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন।
এসব অভিজ্ঞতা আমার কেন হল? আমি কি এসব খুঁজে বেড়াই? নিশ্চয় নয়। আহমদ ছফাকে নিয়ে কেউ কিছু লিখলে কিংবা তাঁকে নিয়ে কাউকে কিছু বলতে দেখলে আমি নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রাখি। আমি জানি ওসবে সারবস্তু আমি কিছু পাব না।
তারপরেও কিছু কিছু লেখা আমাকে বাধ্য হয়ে পড়তে হয়। প্রায় সময় আহমদ ছফাকে নিয়ে আজেবাজে লেখা কোন কোন শুভাকাঙ্ক্ষী আমার ম্যাসেঞ্জার অথবা হোয়াটস্অ্যাপে পাঠান এবং তারা আমার কাছে এসব আজেবাজে লেখার প্রতিক্রিয়া জানতে চান। এসব লেখার সত্য মিথ্যা কতটুকু লিখে জানানোর জন্য আমার কাছে অনুরোধ করেন। কেউ কেউ এমনভাবে জানতে চান যেন আহমদ ছফার সব ব্যাপারে জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য। হয়তো তাঁরা আহমদ ছফাকে যেরকম ভালোবাসেন আমাকেও একই চোখে দেখেন। তাঁরা যে আমার কাছে জানতে চান তাঁদের আমি দোষ দেই না। কিন্তু যেসব ব্যাপারে তাঁরা আমার কাছে জানতে চান সেসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি এক রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাই।
আমি অনেকবার বলেছি, আহমদ ছফাকে খুব কম পাঠক বোঝার ক্ষমতা রাখেন। মিষ্টি সকলে না খেলেও চানাচুর মোটামুটি সকলে খায়। সেটি মাথায় রেখে কিছু লোক আহমদ ছফাকে নিয়ে আজেবাজে চানাচুর সদৃশ লেখা পাঠকদের খাওয়ায়। তারা জানে, চানাচুর জাতীয় লেখার পাঠকের অভাব নেই। সিনেমার নায়ক নায়িকাদের স্ক্যান্ডাল যত বেশি প্রচার পায়, তাদের ভালো কাজ নিয়ে খুব বেশি কথা হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, নায়ক নায়িকারা কোন ঘটনার সাথে নেই পাছে নেই, তারপরেও তাদের নিয়ে ঘটনা বানায়। বানায়, এ কারণে বানায়, কিছু কিছু পাঠক এসব খুব পছন্দ করে। খারাপ জিনিসের প্রতি অনীহা থাকলেও জানার আগ্রহ থাকে প্রবল। এটা নতুন কোন বিষয় নয়। আহমদ ছফার বেলায়ও এসব ঘটে চলেছে অবিরত। কেউ কেউ আহমদ ছফাকে নিয়ে গল্প বানানোর প্রজেক্ট নিয়ে বসেছে। আহমদ ছফা নিজেই বলেছিলেন, আমি মারা গেলে নানাকথা হবে, নানাজনে নানাগল্প বানাবে। কোন প্রেক্ষিতে সেটি তিনি অনুমান করেছিলেন বলতে পারব না, তবে তাঁর অনুমানের যে ব্যর্থয় ঘটেনি এখন তা আমাদের সামনে দিবালোকের মতো সত্য হয়ে উঠেছে।
আহমদ ছফাকে নিয়ে অনেকে আজেবাজে লিখছেন। কেন লিখছেন? দুই কারণে লিখছেন। এক শ্রেণির লোক যারা আহমদ ছফার সাহিত্য বিশেষ পড়েননি, পড়লেও ভাসা ভাসাভাবে পড়েছেন, অথবা বেশি পড়লেও তারা তাঁর সাহিত্য কিংবা তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেননি। আরেক শ্রেণি আছেন তারা কখনওই আহমদ ছফাকে সহ্যই করতে পারতেন না। সহ্য করতে না পারলেও জীবদ্দশায় তারা টু শব্দ করার সাহস করেননি।
মরা গরুর বাঘ হওয়া খুবই সহজ। মরা গরুকে করায়ত্ত করতে শক্তি খাটাতে হয় না। আহমদ ছফা আজ নেই। ফলে তাঁকে নিয়ে যদি আমি যাইচ্ছে বলি তাঁর বাপের সাধ্য নেই কবর থেকে উঠে এসে দু কথা শুনিয়ে কান গরম করার। সে সুযোগ নিয়ে এখন অনেকে কচ্ছপের মতো খুলি থেকে মাথা বের করে আহমদ ছফাকে নিয়ে আজেবাজে কথা লিখে আত্মপ্রচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নিজেরা পণ্ডিতি জাহির করছেন। কেন করছেন? আগেই বলেছি, আহমদ ছফা নামটি বড়ই বরকতময়, যে যা বলে সকলে খায়। আমাদের জানা নেই, আর কোন লেখককে নিয়ে এত কিছু হয়েছে কি না। আহমদ ছফা মারা যাওয়ার পর থেকে কতকিছুরই তো সাক্ষি হতে হল!
অনেকে বলছেন, আহমদ ছফা সুবিধাবাধী, ধান্দাবাজ একজন লেখক। তাঁর লেখা স্ববিরোধী। তিনি কখন কি বলেন তার কোন ঠিক নেই। আহমদ ছফাকে জীবদ্দশায়ও এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি সব প্রশ্নের জবাব নিঃসংকোচে দিয়ে যেতেন। এসব প্রশ্নের জবাব এখন আমার কাছে চায়। এ চাওয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত আমি বলতে পারব না।
আহমদ ছফাকে নিয়ে যারা ভাসা ভাসাভাবে লেখেন, গল্প বানান তারা গভীরভাবে তাঁকে পড়েন না, আর পড়লেও তাঁর লেখার গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখেন না। আহমদ ছফাকে জানতে এবং বুঝতে হলে তাঁর দুটি দিককে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। একটি হল তাঁর ব্যক্তিজীবন, অপরটি তাঁর সাহিত্য। সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিজীবন কম গুরুত্বের নয়। তাঁর ব্যক্তিজীবনেরও একটা ভাষা ছিল। সাহিত্য যারা করেন তাদের অনেকে নিজে যা নন, বাস্তবজীবনে যা করতে অভ্যস্ত নন সেসব সাহিত্যে তারা বেশ সুন্দর করে তুলে ধরেন। আহমদ ছফা সেদিক থেকে একেবারে স্বতন্ত্র ছিলেন। তিনি তাঁর চিন্তা এবং কাজ সমান্তরাল গতিতে চালিত করতেন। যে কারণে তাঁর চিন্তাকে জানান দেওয়ার জন্য তিনি মাঠেও নেমে যেতেন। তাঁর আরও একটা দিক ছিল। একপেশে লেখায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। মেঘ নিয়ে লিখতে গিয়ে মেঘের ওপারে যে একটা সূর্য আছে তাকে নিয়েও তিনি ভাবতেন। মেঘ যেমন শঙ্কার, আবার আশীর্বাদেরও, এমনকি সুন্দরও। সব মিলিয়ে দেখাটা ছিল আহমদ ছফার স্বভাব।
কোন মানুষকে তিনি দেবতার মতো করে যেমন দেখতেন না, আবার কাউকে পুরোপুরি অসূর ভাবাটাও তাঁর স্বভাবে ছিল না। তিনি যার গুণগান গাইতেন তাকে আবার শাসনও করতেন, গালমন্দ করতেও দ্বিধা করতেন না। এজন্য আমি আহমদ ছফাকে বলি বাবার মানসিকতার লেখক। বাবা যেমন তার সন্তানকে আদর সোহাগ দিয়ে বুকে আগলে রাখতে চান, আবার তিরস্কার করে মারধর করতেও তিনি পিছ পা হন না। এ পর্যন্ত আমি আহমদ ছফার লেখায় কোন মানুষকে একাধারে দেবতা অথবা অসূর ভাবতে দেখিনি। তাঁর গল্প উপন্যামের চরিত্রগুলোও অনুরূপ। তার কিছু উদাহরণ আমরা হাজির করতে পারি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলি না কেন। তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করা আহমদ ছফার অনেক লেখা রয়েছে, আবার তাঁকে নিয়ে সবচে মূল্যায়নধর্মী ভালো লেখাও তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই যে ভালোমন্দ দুভাবে দেখা, এজন্য আহমদ ছফাকে অনেকে বলছেন সুবিধাবাদী অথবা ধান্দাবাজ লেখক। একজন মানুষকে কখনও একশ ভাগ সঠিক কিংবা একশ ভাগ নষ্ট সেটি বলা যাবে না। যারা আহমদ ছফাকে এ দোষটি দেন তাদের আমি দোষ দেব না। আমাদের সমাজে এমন একটি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে, যে মানুষ যার কাছে পছন্দের সে তার কাছে একশ ভাগ সাচ্ছা, আর যে পছন্দের নয় সে একেবারে নষ্ট, নর্দমার কীট। এ মানসিকতা থেকে আমরা খুব কম মানুষই সহজে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
আহমদ ছফা যাদের পছন্দ করতেন, অথবা যাদের তিনি বাজেভাবে জানতেন তাদের সম্পর্কে একপেশে মনোভাব তাঁর ছিল না। হুমায়ূন আহমেদ জগদ্বিখ্যাত লেখক হবেন তিনি এ স্বপ্ন দেখেছিলেন। এটি ছিল তাঁর প্রথমদিককার ভাবনা, এজন্য তিনি তাঁর জন্য কম করেননি। কিন্তু আহমদ ছফাকে সে জায়গা থেকে পরে সরে আসতে হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের পরের লেখায় আহমদ ছফার মন বসেনি। শিল্পী সুলতানকে নিয়ে আহমদ ছফা করেননি এমন কোন কাজ নেই, আবার এটাও বলেছেন সুলতান একজন মেরুদণ্ডহীন মানুষ। তাঁর সাহস নেই।
হুমায়ুন আজাদ আহমদ ছফার বন্ধু ছিলেন। তিনি আজাদ সাহেবের অনেক সমস্যার কথা জানতেন, কিন্তু কখনও বলাবলি করেননি। যখন হুমায়ুন আজাদ নিজে গায়ে পড়ে ঝগড়াটা বাধালেন আহমদ ছফা তাঁকে নানা বিশেষণে বিশেষিত করলেন। হুমায়ুন আজাদের নারী গ্রন্থ যখন নিষিদ্ধ হয় আহমদ ছফাই প্রথম প্রতিবাদ করেন এবং ফুটপাতে বসে সে বই বেচার সিদ্ধান্ত নেন। এখন দেখি আহমদ ছফা এবং হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে নানাজনে বাজে গল্প বানায়। আহমদ ছফাকে হুমায়ুন আজাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে চরম সুখ অনুভব করে। হুমায়ুন আজাদ কি একেবারে ফেলনা লেখক!
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে আহমদ ছফা অনেক সমালোচনা করেছেন, পাশাপাশি তিনি চৌধুরী সাহেবের ঋণের কথা অকপটে বলে গেছেন। এও বলেছেন, আমার দুঃসময়ে তিনি আমাকে চল্লিশ টাকা ধার দিয়েছিলেন, যে টাকা শোধ করার ক্ষমতা আমার জীবনে হবে না। এখানে দুজনে হয়ে উঠেছেন মহৎ। গুরু প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে বলেছেন, “যদ্যপি আমার গুরু”। অর্থ তো এ রকমই, যদিও তিনি আমার গুরু। এ তিনটি শব্দ বলে দেয়, রাজ্জাক সাহেবও ধোয়া তুলশী পাতা নন, তাঁর ভেতরেও সমস্যা আছে। আহমদ ছফা ভোরের আলো ফোটার আগে ফরহাদ মজহারকে “হযরত” সম্বোধন করে প্রায় প্রতিদিন প্রথম ফোনটি করতেন। তাঁরা খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। কিন্তু ফরহাদ মজহারকে নিয়ে এত তিক্ত কথা তিনি বলেছেন তা গা শিউরে উঠার মতো।
সলিমুল্লাহ খানকে নিয়ে যেসব কথা বলতেন কানে আঙুল দিতে হতো। কিন্তু তাঁর মধ্যে আহমদ ছফা সম্ভাবনা দেখতেন। বলতেন, একজন প্রতিভাবান প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ। রবীন্দ্রনাথকে চোর বলেছেন, পাশাপাশি বলেছেন বড় লেখকরাই জোড়াতালি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এও বলেছেন, বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারও লেখায় আমি ভালোভাবে মন বসাতে পারি না। বঙ্কিমকে ছাঁচাছোলা করলেও সাহিত্যের যোগ্য আসনটা ছেড়ে দিতে আহমদ ছফা কার্পণ্য করেননি। তাসলিমা নাসরিনের কঠোর সমালোচনা করেছেন আহমদ ছফা। কিন্তু নির্বাচিত প্রবন্ধের তিনি প্রশংসা করেছেন। আমাদের গ্রামের অনেক মেয়েকে বইটি পড়ার জন্য কিনে দিয়েছেন।
আবুল হাসানকে পড়াশুনার খরচ দিয়েছেন। সে আবুল হাসান আহমদ ছফাকে আহত করে কথা বলেছেন। তিনি হাসানকে মারধরও করেছেন। কিন্তু হাসানের মৃত্যুর আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় আহমদ ছফাকে দেখা যায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে।
কবি শামসুর রাহমান এবং কবি আল মাহমুদকে অসম্ভব রকম শ্রদ্ধা তিনি করতেন। কিন্তু তাঁরাও আহমদ ছফার খড়গ থেকে রেহাই পাননি। আমি তো তুচ্ছ মানুষ। আমাকে তিনি হাজার রকম গালমন্দ করতেন, সবচে বেশি আদর স্নেহও আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। যখন তিনি আমার মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে আদর দিতেন আমি পিতৃহারা কষ্ট ভুলে যেতাম। তিনি বলতেন, গোটা পৃথিবীর অধঃপতন ঘটলে যত কষ্ট আমি পাব তার চে বেশি কষ্ট পাব তোমার অধঃপতন দেখলে।
“সূর্য তুমি সাথী” উপন্যাসের খলচরিত্র খলু মাতাব্বর জমি সংক্রান্ত এক মামলায় আহমদ ছফাকে আসামী করেছিলেন। আহমদ ছফা এ নিয়ে কোন রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে খলুকে একটি পাঞ্জাবি এবং একখানা গায়ের চাদর পাঠিয়ে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন আমি তোমার সমগোত্রের নই। কিন্তু খলু প্রচার করেছেন আহমদ ছফা ভয় পেয়ে তার কাছে কাপড় পাঠিয়েছেন। এখানেই আহমদ ছফা মহৎ। এ রকম আহমদ ছফার অনেক উদাহরণ টানা যাবে।
গত কয়েক বছর আগে একজন লেখকের মঙ্গে আমার তর্ক হয়েছিল। তিনি আহমদ ছফার বন্ধু ছিলেন। সে তর্কে তিনি লিখেছেন, একটা বিষয়ে আহমদ ছফাকে তিনি পছন্দ করতেন না। যেকোন কারণে একজন মানুষকে পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু এ ভালো মানুষটি আহমদ ছফাকে পছন্দ না করলেও প্রায় সময় তাঁর ঘরে এসে বসে থাকতেন। এ লেখকের কথায় আহমদ ছফাকে নিয়ে এক পিএইচডিধারী লিখলেন, স্যার, সেটি আমারও চোখে পড়েছে, কিন্তু থিসিসে আমি সেটি লিখিনি, তাঁর সম্মানহানীর ভয়ে।
আহমদ ছফার প্রতি তার উদারতা দেখে আমি তো একেবারে হতবাক। তার সাহস হয়েছে, সময় করে তিনি বিষয়টি নিয়ে লিখবেন। প্রশ্ন হলো, একটা বিষয় আপনার চোখে পড়ার পর এড়িয়ে গেলেন, তাতে আপনার ড. ডিগ্রি কতটুকু যথার্থ হয়েছে, তার একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যায়। ওই যে বলেছিলাম আহমদ ছফাকে নিয়ে ধান্দাবাজি নানাভাবে হয়, এটি তারই একটি নমুনা।
বহুভাবে আহমদ ছফাকে নিয়ে চিন্তা করা যায়। এক অর্থে আহমদ ছফা পাগলও ছিলেন, যে পাগলামি সরাচর কেউ করে না। একটা ঘটনার কথা বলি। আহমদ ছফা মিরপুরের রূপনগরে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। সেটি হাউজিং সোসাইটি থেকে কিনেছিলেন পঁচিশ বছরের কিস্তিতে। মাসে আট শ চল্লিশ টাকা করে তাঁকে কিস্তি দিতে হতো। সে ফ্ল্যাটটি এত ছোট ছিল সিঁড়িসহ মাত্র সাড়ে পাঁচ শ ফুটের বেশি নয়। ওখানে আমি তিন বছর ছিলাম। কিস্তি শেষ হওয়ার আরগ তিনি ফ্ল্যাটটি বেচে দেন। ওই সময় আমি গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। একদিন আহমদ ছফা আমাকে চিঠিতে লিখলেন, আমি বাড়িটি বেচে দিয়েছি। এ মুহূর্তে টাকাটা খুব দরকার। কিছু ধারদেনা ছিল সেটি শোধ করতে হবে। সলিমুল্লাহ খান পিএইচডি করতে দেশের বাইরে গেছে তাকে কিছু টাকা দিতে হয়েছে।
একান্নব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের এলাকায় গরিব মানুষের বেশ কিছু ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। বিজিএসকে তিনি রাজি করিয়েছিলেন গাছবাড়িয়াতে যেন কিছু ঘরের ব্যবস্থা করে দেন। বিজিএস একশ বিশটি ঘর করে দেয়। তার মধ্যে ষাটটি ঘরের শুধু চালের টিন দিয়েছিলেন। আহমদ ছফা সেখানে একটি অংশের খরচ নিজে বহন করেন। তিনি চিঠিতে আমাকে লিখেছিলেন, আমার এলাকার মানুষের ঘর নেই, অথচ আমি ঘরে ঘুমাব সেটি হতে পারে না। বিষয়টি আমি যেন পাঁচকান না করি সে ব্যাপারেও তিনি আমাকে সতর্ক করেছিলেন। তিনি আমাকে আশ্বস্থ করেছিলেন, তুমি মন খারাপ করো না, এত ছোট ঘরে মানুষ থাকতে পারে না, আমরা সাভারের দিকে একটা বড় বাড়ি করব। বিজিএস যে ঘর দিয়েছিল তার পেছনে আমাকে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।
কে একজনের লেখা পড়ে খুব হাসলাম। আহমদ ছফা এমন ধান্দাবাজ, তিনি “ফাউস্ট” অনুবাদ করে জার্মানির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে বহু টাকার মালিক হয়েছিলেন। অনেকে জানেন, পুরনো বইয়ের স্তূপের ভেতর “ফাউস্ট” বইটি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। সেটি ফাউস্ট নাকি অন্যকোন বই তাঁর জানা ছিল না। বইটির সামনের পেছনের অংশ খোয়া ছিল। আহমদ ছফা এ নাম না জানা বইটি পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন তার সম্পর্কে তথ্য তালাশ করতে নানাজনের কাছে ছুটতে হয়েছিল। পরে তিনি জেনেছিলেন সেটি জার্মান লেখক গ্যোতের অমর সৃষ্টি “ফাউস্ট”। ওই সময়ে তিনি বইটি অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তখন থেকে তিনি বইটি অনুবাদে লেগে যান। এই বই অনুবাদের পেছনে তাঁকে পনের ষোল বছর লেগে থাকতে হয়। এখন কেউ যদি বলে জার্মান সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আহমদ ছফা ফাউস্ট অনুবাদ করেছিলেন, তার জবাব কী হতে পারে আমাদের জানা নেই। আহমদ ছফার অনূদিত সেই ফাউস্ট এখন বাংলাসাহিত্যে বড় একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
আহমদ ছফাকে নিয়ে এসব এখন নতুন কিছু নয়। চিলে কান নিয়ে গেছে বললেই মানুষ চিলের পেছনে দৌড়ে। আদৌ চিলে কান নিল কি নিল না সেসব পরখ করার সময় আমাদের হাতে নেই। আমরা চিলের পেছনে ছুটতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
আহমদ ছফাকে নিয়ে একধরনের নোংরা প্রতিযোগিতার কথা অনেকে বলেন। সত্যমিথ্যা পরখ করার সময় হয়নি। তবে অনেককে বলতে শুনি, আমি আহমদ ছফাকে নিয়ে এই করেছি, সেই করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এক গবেষককে তো প্রায় বলতে শুনি, আহমদ ছফাকে নিয়ে আমি যত বড় কাজ করেছি আর কেউ করেনি। এসব শুনে আমি হাসি, আর সলিমুল্লাহ খানকে দেখলাম আফসোস করতে।
আরেকটি কথা বলে লেখাটির এখানে ইতি টানতে চাই। আহমদ ছফাকে নিয়ে যারা কথা বলেন, যারা লেখেন, যারা আহমদ ছফাকে পড়েন তাদের একজনকেও মনে হয়নি তাঁরা আহমদ ছফাকে মানুষ ভাবেন। তারা তাঁকে মনে করেন হয় দেবতা নয়তো অসূর। এ একপেশে চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আহমদ ছফার মূল্যায়নটা আরও সুন্দর হতো।
-নূরুল আনোয়ার, লেখক ও গবেষক; আহমদ ছফার ভাতিজা।
Source link