প্রসূতি মায়েদের অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বন্ধ করা উচিত – শেয়ার বিজ
প্রসূতি মায়েদের অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বন্ধ করা উচিত – শেয়ার বিজ

রিয়া বসাক:সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ সবাইকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলেও মাতৃত্বের মতো স্বর্গীয় অনুভূতি লাভের ক্ষমতা দিয়েছেন শুধু নারীদেরই। একজন নারীর জীবনে সর্বোচ্চ খুশি, আবেগ ও উৎকণ্ঠার সময় হলো মাতৃত্বকালীন সময়, কারণ তার হাত ধরেই কিছুদিন পর পৃথিবীতে আসে নতুন প্রজš§। গর্ভবতী মা-সহ পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য যেমন আনন্দে থাকে, তেমনি বিভিন্ন চিন্তাও এসময় মাথায় ঘুরপাক খায় প্রসূতি মায়ের স্বাভাবিক সন্তান জš§দান নিয়েÑশেষ পর্যন্ত মা ও সন্তান দুজনেই সুস্থ থাকবে কি না? পরিবারের সদস্যরা হয়তো সন্তান জš§দানের সময়টুকু পর্যন্তই উৎকণ্ঠায় কাটায়, পরবর্তী সময়গুলো নিয়ে ভাবে না বললেই চলে। যার ফলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে কারও তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশে বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যা বেশ শঙ্কাজনক।

সন্তান জš§দানের সময় অস্ত্রোপচার একটি জীবনরক্ষাকারী পন্থা, কিন্তু যখন এই পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে অকারণে, সেটি রীতিমতো একপ্রকার অপরাধ। আগের যুগে সন্তান জš§দানে ধাত্রীর প্রচলন ছিল, কিন্তু সে সময় মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হারও বেশি ছিল। এজন্য ক্রমে ক্রমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসপাতালে সন্তান জš§দানের হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। বর্তমানে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে আনন্দজনক; কিন্তু একই সঙ্গে হার বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের।

সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০২২) অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে, দেশে ১০০টি সন্তান প্রসবে ৪৫টি শিশুর জš§ হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। মোট সংখ্যার হিসাবে দেশে প্রতিবছর ১৬ লাখ শিশুর জš§ হচ্ছে এভাবে। এর মধ্যে ১০ লাখের বেশি শিশুর জš§ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে।

প্রসূতি মায়ের যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হƒদপিণ্ডজনিত কোনো সমস্যা, অথবা জরায়ুতে টিউমার থাকে এবং বাচ্চার অবস্থানের ত্রুটি থাকে, সেক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী পন্থা হিসেবে অস্ত্রোপচারকে বেছে নেয়া যায়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই নির্ধারিত সময়ের আগে অস্ত্রোপচার কতটুকু যৌক্তিক?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, প্রতি ১০০ গর্ভধারণে ১০ থেকে ১৫ জন মায়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা যায়, যেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। কিন্তু ১৫ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচার হলে তা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কিন্তু বর্তমানে দেশে ৩০ শতাংশ শিশুর জš§ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ভাষ্য: সাধারণত চার কারণে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বাড়ছেÑক. বেশি বয়সে বিয়ে; খ. গর্ভবতী মায়েরা অথবা তার পরিবার ইচ্ছা অনুযায়ী; গ. হেলথ চেকআপ এবং ঘ. বেসরকারি হাসপাতালের মুনাফার প্রবণতা।

অনেক সময় দেখা যায়, চিকিৎসকরা অনাগত সন্তানের বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ অবস্থানের দিক দেখিয়ে ভয় দেখান এবং অস্ত্রোপচার করতে বলেন তৎক্ষণাৎ। এতে পরিবারের লোকজন ভয় পান এবং সে মুহূর্তে তাদের ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এসব ঘটনার সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। একমাত্র চিকিৎসকই বুঝবেন কতটুকু প্রয়োজন ছিল অস্ত্রোপচারের। এ অবস্থায় পরিবারের লোকজন বাধ্য হয়ে অস্ত্রোপচারে অনুমতি দেন।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের লোকেরা আগে থেকেই চান অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করাতে। কেউ হয়তো ভয়ে চান, অথবা কেউ চান ফিটনেস ঠিক রাখতে, যা অনেক ক্ষেত্রে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ভাবেন স্বাভাবিকভাবে প্রসব করালে সমাজের লোকেরা ভাববে কৃপণ, সেজন্য নিজেদের সামর্থ্য জাহির করাতে গিয়ে আগে থেকেই বেছে নেন অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের পন্থা। তাদের মধ্যে অনেকের হয়তো অস্ত্রোপচার করার সময় বা করার পরও তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না, যার ফলে এই পন্থাতেই তারা বেশি আস্থা পান। কিন্তু সুপ্তভাবে বাচ্চারা কোনো দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বঞ্চিত হচ্ছে কি না, সেটা ভাবেন কজন?

এর কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে, যেসব অনেকে গুরুত্ব না দেয়ার ফলে এই হার কমার বদলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে সংক্রমণ ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় এ ধরনের মায়েদের সুস্থ হতে সময় লাগে বেশি। এছাড়া সন্তান বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত হয়, যেমন স্বাভাবিক প্রসবের সময় শিশু ভালো কিছু ব্যাকটেরিয়া লাভ করে, যা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে এটি সম্ভব নয়। এছাড়া মা অসুস্থ থাকায় শিশুকে মায়ের থেকে কিছু সময় দূরে রাখা হয়, যার ফলে শিশু মায়ের দুধ পান করতে পারে না ঠিকমতো। অনেক সময় অস্ত্রোপচারে সামান্য ত্রুটি হলেও মা অথবা শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে। অস্ত্রোপচার করার আগে পরিবারের সব সদস্যের এ বিষয়গুলো জানা উচিত।

অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বড় অংশটি হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। ৮৪ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে এবং ১৪ শতাংশ হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে জনবল কম থাকায় সবাই ঝুঁকছে বেসরকারি হাসপাতালের প্রতি। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করে মোটা অঙ্কের অর্থ লাভ করছে।

গবেষকরা দেখেছেন, স্বাভাবিক প্রসবে গড়ে তিন হাজার ৫৬৫ টাকা করে খরচ হয়। স্বাভাবিক প্রসবের পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের কারণে প্রতিটি প্রসবে বাড়তি খরচ হয়েছে ১৮ হাজার ৫২০ টাকা। ২০২২ সালে শিশুজšে§ বাড়তি খরচ হয়েছে এক হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। স্বাভাবিক প্রসবে ঝুঁকি কম হওয়ার প্রসূতি মায়েরা দ্রুতই বাড়িতে ফিরে যেতে পারে, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে বাচ্চাসহ মাকে কিছুদিন হাসপাতালেই রাখা হয়, কারণ তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগে। হাসপাতালে থাকার জন্য দিনপ্রতি যে অতিরিক্ত খরচ, সেটিও মুনাফা হিসেবে পেয়ে যায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো।

অস্ত্রোপচার ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা, যেটি বহন করার সামর্থ্য সব পরিবারের নেই, কিন্তু কতিপয় চিকিৎসক বাধ্য করে এটি করাচ্ছে নিজেদের ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ চরিতার্থে। সরকারের ও চিকিৎসা খাতসংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উচিত অতি সত্বর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া এবং অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার রোধ করা। তার পাশাপাশি জনগণের সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে জানা উচিত অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ভয়াবহতা এবং এটি কমাতে সাহায্য করা। প্রত্যেকে সচেতন হলে তবেই সম্ভব সুস্থ সমাজ, দেশ ও জাতি গঠন করা।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *