বাড়ছে তাপ, বাড়ছে বন্যা, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ
বাড়ছে তাপ, বাড়ছে বন্যা, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ

মাত্র তিন মাসের মধ্যে পানিশূন্য হয়ে যাবে গোটা কেপটাউন শহর—বিশেষজ্ঞদের এই ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছিল ২০১৮ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের প্রায় ৪০ লাখ নাগরিক রীতিমতো যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল। পানি বাঁচানোর জন্য রীতিমতো লড়াইয়ে নেমেছিল গোটা শহর। যে কেপটাউনে একসময় গৃহস্থালির ব্যবহারে প্রতিদিন প্রায় ৫০ কোটি লিটার পানি খরচ হতো, তা কমিয়ে ২৫ কোটি লিটারের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরও সেই শহরের বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হয়নি। কেপটাউনসহ গোটা পশ্চিম কেপ প্রদেশে বৃষ্টি হয়েছিল নামমাত্র। সবাই বুঝতে পেরেছিল, পানির ভান্ডারে রীতিমতো টান পড়ছে। কেপটাউন পৌরসভা ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঘোষণা করেছিল, তিন মাস পরে কেপটাউনবাসীকে তারা আর পানি সরবরাহ করতে পারবে না। ১২ মে ২০১৮ দিনটিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘ডে-জিরো’ হিসেবে। অর্থাত্, ঐ দিনের পরে শহরের কোনো কল থেকে আর পানি পড়বে না। শুধু কেপটাউন নয়, পুরো বিশ্বই সেদিন এই খবরে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। ঠিক এর পরই পানির সংকট নিয়ে ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা শুনিয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব জিওগ্রাফি’। চলতি বছরে তাদের গবেষণা দাবি করছে, প্রবল গরম ও খরার মুখোমুখি হতে চলেছে বিশ্বের ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা। পানির হাওয়া বিচার করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রবল গরমে স্থলভাগে পানির সংকট দেখা দেবে। জমিতে পানির ভাগ কমবে; খরা তৈরি হবে অবধারিত। 

এত সাবধানতার পরও কোথাও নদী পুরোপুরি শুকিয়ে যাচ্ছে, কোথাও ভয়ংকর দাবানলে পুড়ছে বনাঞ্চল আর তৎসংলগ্ন বসতি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি রিপোর্ট বলছে, গত ৫০০ বছরে এমন ভয়াবহ খরা দেখেনি মহাদেশ। খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, হাংগেরি, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, মলডোভা, নেদারল্যান্ডস, সার্বিয়া, পর্তুগাল, ব্রিটেন, স্পেন, রোমানিয়ার মতো দেশেও। আমেরিকার অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, হংকং পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাস টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণা জানাচ্ছে, তাপপ্রবাহের তীব্রতার সঙ্গে বাড়বে খরার তীব্রতা। আগের চেয়ে খরার তীব্রতা আরো ঘন ঘন হবে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর উত্তর আমেরিকার মধ্যাঞ্চলে। গ্রীষ্মকালে দু-তিন দিনের মধ্যেই মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। কোনো ফসল উৎপাদন তখন অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিতে পড়বে এই অঞ্চলের কৃষিনির্ভর দেশগুলো। প্রভাব পড়বে বাস্তুতন্ত্রে, প্রবলভাবে ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। 

তাপমাত্রা বাড়ার কারণে আমাদের ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়তে হচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে দেখা গেছে, ঝড় আছড়ে পড়ার সাত দিন আগে থেকেও তার গতিপথ নির্দিষ্ট করা যাচ্ছিল না। এমন ঘূর্ণিঝড়ের অস্থির চরিত্রের কারণ সমুদ্রস্রোত; আর এমন সমুদ্রস্রোতের কারণ উষ্ণতা বৃদ্ধি। অন্যদিকে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। চাহিদার প্রয়োজনে বাড়ি, অফিস, কারখানায় এয়ার কন্ডিশনার, এয়ারকুলার যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি বেশি পোড়ানোর কারণে বায়ুদূষণ ভয়াবহভাবে বাড়ছে। অন্যদিকে আরো বেশি পানির জোগান দিতে অনেক বেশি পাম্প চালাতে হচ্ছে। এতে ক্রমশ নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। 

কিন্তু তার পরও নির্বিচারে গাছ কাটা, পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন গড়া, বাতাসে নিরন্তর কালো ধোঁয়া ছেড়ে পথ চলা—আজ যেন নাগরিকদের প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবেশের জন্য যে সচেতনতা আসার প্রয়োজন ছিল, তা যেন একেবারেই অনুপস্থিত। তারা মনে করে, এগুলো সাধারণ মানুষের বোঝার বিষয় নয়—এগুলো জ্ঞানের কথা। এখন তো সবই দৃশ্যমান! পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিত হচ্ছে। এমন বাস্তব পরিস্থিতি প্রতি মুহূর্তে দৃশ্যমান হচ্ছে। বিপদ শুধু বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। পৃথিবীর যে কটি বড় সমস্যা আগামী দিনে বিধ্বংসী রূপ নিতে পারে, তার মধ্যে জলবায়ু কিংবা গ্রিনহাউজ গ্যাস সমস্যা অন্যতম। জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড মেটেরিওলজিক্যাল অর্গানাইজেশন’-এর রেকর্ড বলছে, সারা বিশ্বেই গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। কয়লা, জ্বালানি তেল ও গ্যাস বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক অবদান রাখার মাধ্যম। বিশ্বব্যাপী ৭৫ শতাংশের বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন এবং মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের প্রায় ৯০ শতাংশের জন্য দায়ী কয়লা, জ্বালানি তেল ও গ্যাস। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন পৃথিবীকে ঢেকে দেয় একটা গ্যাসের চাদরে। এই চাদরই সূর্যের তাপকে মহাকাশে ফিরে যেতে না দিয়ে আটকে রাখে। ক্রমসঞ্চিত এই গ্যাসের চাদর পৃথিবীকে উষ্ণতর করে তোলে এবং জলবায়ু পরিবর্তন করে।

দ্রুত নগরায়ণের স্বার্থে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে গাছ, বন-জঙ্গল নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে এসব বন-জঙ্গল ও গাছ আগে যে পরিমাণ কার্বন ধারণ করতে পারত, এখন তা বাতাসেই ভেসে থাকে। ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের চাপ বাড়ছে। গণপরিবহনব্যবস্থা ভেঙে ফেলে ক্রমাগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল গাড়ি, ট্রাক, জাহাজ এবং বিমান কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের প্রধান ক্ষেত্র। গোটা বিশ্বে মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের প্রায় এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী এই পরিবহনব্যবস্থা। বর্তমানের খাদ্য উত্পাদনের প্রক্রিয়াও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। চাষের জন্য বন উজাড় করে চারণভূমি তৈরি করা, ফসল ফলানোর জন্য সার ব্যবহার করা, সার উৎপাদন ও খামারের যন্ত্রপাতি কিংবা মাছ ধরার নৌকা চালানোর জন্য সবকিছুতেই যে শক্তি ব্যবহার করা হয়, সাধারণত তা আসে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে। 

বিশ্বায়ন ও ভূ-উষ্ণায়ন একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আমাদের জীবনধারাই আমাদের গ্রহের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। তবে এক্ষেত্রে ধনীরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের জনসংখ্যার ১ শতাংশ ধনী ৫০ শতাংশ দরিদ্রের চেয়েও বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। অনেক অঞ্চলে ঘন ঘন ধ্বংসাত্মক ঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে সারা পৃথিবীতে বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা, যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্তমান বিশ্ব মানব ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ১ হাজার গুণ বেশি হারে জীবন্ত প্রজাতি হারাচ্ছে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতি বছর বর্তমান পৃথিবীতে পরিবেশগত সমস্যার কারণে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর গড়ে ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর সর্বত্র বজ্রপাতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০৯০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে বজ্রপাত ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

অতীতে মানুষ ছিল প্রকৃতির অধীনে; কিন্তু বর্তমানে প্রকৃতি মানুষের অধীনে। প্রকৃতিকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে ইচ্ছেমতো আজকের পৃথিবীতে। জীবনধারা সহজ করার জন্য প্রযুক্তির কল্যাণকে মানুষ কাজে লাগাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তাতে পরিবেশ কতটা নষ্ট হচ্ছে, তা ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারছে না সেই মানুষই। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। যেখানে একটি দেশের বনাঞ্চল থাকার কথা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের বনাঞ্চলের পরিমাণ মাত্র ১৭ শতাংশ। তার পরও প্রতি বছরই এই পরিমাণ কমছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ২০৫০ সাল নাগাদ ধানের উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ কমবে এবং গমের উৎপাদন কমবে প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদশে বাস্তুচ্যুতির শিকার হতে পারে সাড়ে তিন কোটি মানুষ। 

জলবায়ুর পরিবর্তনের ধাক্কা সইতে গিয়ে পৃথিবীর ধনকুবের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অনেকটাই নাজেহাল। কেঁপে উঠেছে তার অর্থনীতি। এই বন্যা তো এই খরা! তার একটি ঘা না শুকাতেই দুয়ারে অন্য ঘা পড়ছে। জলবায়ুর মেজাজ-মর্জিতে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রীতিমতো সমস্যার মুখে। সেখানকার সবচেয়ে বড় বিমা কোম্পানি স্টেট ফার্ম বাড়িঘরের বিমা বিক্রিতে ইতি টেনে দিয়েছে। কারণ সেখানে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ে বাড়িঘরের এত ক্ষতি হচ্ছে যে, বিমার টাকা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না বড় বড় বিমা কোম্পানি। আমেরিকার যদি এমন দশা হতে পারে, সেখানে জলবায়ুর জন্য সবচেয়ে বিপদে থাকা বাংলাদেশের অবস্থা সামনে কতটুকু ভয়াবহ হতে পারে? 

লেখক : কলাম লেখক 

 


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *