বাই চান্স নুর | চিন্তা
বাই চান্স নুর | চিন্তা

এক.

‘সুযোগ সন্ধানী’ বলে সমসাময়িক রাজনীতিতে একটা কথা প্রচলিত, অবশ্য এটা বহু আগে থেকে চলে আসছে। কিন্তু কথাটা শোভন নয়। অথচ আমাদের দেশে সুযোগ সন্ধানী লোকের সংখ্যাই দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদেরই একজন নুরুল হক নুর প্রথম থেকে যাকে ‘সন্দেহভাজন’ মনে হয়েছে। সম্প্রতি ইসরায়েলি এবং মোসাদের কথিত এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তার দেখা করার সত্য-মিথ্যা নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে আমার ধারণাটা সঠিক ছিল। রাজনীতির নৈতিক স্খলন ও দুর্ভিক্ষের একটা চরিত্র নুর।

ইসরায়েলকে কখনো বাংলাদেশের মানুষ সমর্থন করে না। ‘নৈতিক রাষ্ট্র’ হিসেবে বাংলাদেশ কখনো স্বীকার করে না। সেই দেশের সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে নুরের এত সখ্য কেন? এত বৈঠক কীসের? শোনা যাচ্ছে একবার নয়, তিনবার তাদের বসা হয়েছে। এটা বাংলাদেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত; রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত। এটা ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ বললে ভুল হবে না। শুরু থেকেই বাই চান্স, সিম্প্যাথি ও ‘চালাকির’ রাজনীতি করেই আজকের নুরুল হক নুর গড়ে উঠেছেন। সুযোগের অভাবে তিনি আরও বড় বড় অপরাধ করতে পারেননি। কিন্তু সুযোগ পেলে নুর যে ‘সাগর চুরির’ মতো মানসিকতা রাখেন সেটি সহজেই অনুমান করা যায়।

দুই.

কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন নুর ছিলেন হল ছাত্রলীগের নেতা। সেই আন্দোলনের প্রধান মুখ তখন হাসান আল মামুন। শাহবাগে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর গ্রেপ্তার এড়াতে মামুনসহ বাকিরা যখন পালিয়ে ছিলেন, তখনই নুর গণমাধ্যমে আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে উঠে আসেন, পরে তিনিই হয়ে যান প্রধান নেতা। তরুণদের সামনে তিনি কিছু সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন, যা তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। ওই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ডাকসুর ভিপিও হলেন তিনি। তার আগে ডাকসুর নির্বাচনের দিন দুপুরে রোকেয়া হলের সামনে ভিড়ের মধ্যে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে নুর অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ক্যাম্পাসে প্রচার হয়, নুরের ওপর ছাত্রলীগের হামলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা ছিল ভিন্ন। নুর স্পষ্টত সেদিন ‘সিম্প্যাথি’ পাওয়ার জন্য ‘অজ্ঞান’ হওয়ার নাটক করে। ওই ঘটনার আগ পর্যন্ত ভোটের চিত্র ছিল ভিন্ন। খুব বেশি শিক্ষার্থী ভোট দিতে যাননি তখনো। নুরের ওই ‘নাটক’-এর পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে যান। অতঃপর ডাকসুর ভিপি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নুর। গণভবনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তার মাকে দেখার কথা প্রকাশ করেন।

কোটা আন্দোলনে পাওয়া জনপ্রিয়তা আর ডাকসুর ভিপি হওয়ার সূত্রে নুরুল হক নুরের আকাক্সক্ষা বড় হয়, তীব্র হতে থাকে। সে লক্ষ্যে ক্যাম্পাস থেকে নিজেকে টেনে আনেন জাতীয় রাজনীতিতে। সে সময় সরকার তার নেতৃত্বে ছাত্রদের কোটা সংস্কার দাবি মেনে নেয়। কিন্তু নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদ রাস্তায় থেকে গেল। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা সরকারবিরোধী প্ল্যাটফরম হিসেবে নিজেদের দাঁড় করাতে থাকেন। একই সঙ্গে ‘শর্টকাট রাস্তা’ খুঁজলেন নুর। বিভিন্ন ফান্ডামেন্টাল গ্রুপের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একই সুরে কথা বলতে শুরু করেন। ‘প্রয়োজনে জামায়াতের সঙ্গে জোট করবে গণ অধিকার পরিষদ’ এমন বক্তব্যও দিয়েছিলেন নুর। তখনই নুরের রাজনৈতিক আদর্শ অনেকটা পরিষ্কার হলেও মিডিয়ায় অনালোচিত থাকেন। দলটির নেতাকর্মীরা সুনির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শিক কাঠামোতে বাধা নেই। এতে ব্যবহারিক রাজনীতিতে যেকোনো দিকে মোড় নেওয়ার সুযোগ থাকছে।

নুরের এক ধরনের স্পষ্ট বামবিরোধিতা আছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নুরদের রাজনৈতিক বিকাশ এভাবেই হয়েছে। ওই সময়ে সমাজ ও রাজনীতির উদারনৈতিক ঘরানার মানুষ নুর ও তার দলকে আশ্রয়, অর্থ এবং আইনি সহায়তা দিয়েছে। তবে সাংগঠনিকভাবে তারা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশেলে আগ্রহীদের কাছে সহায়তা পেয়েছে বেশি।

তিন.

যে কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে নুরুল হক নুরের উত্থান, নৈতিকভাবে সে আন্দোলনের পারসেপশনের বিপক্ষে ছিলাম আমি। সেই আন্দোলনের মতো নুরের অবস্থানের সঙ্গে সুস্পষ্ট দ্বিমত আছে। তিনি যে রাজনীতিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, সেরকমটা কখনো মনে হয়নি।

যদিও দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে সেটা সঠিক মনে হয়েছে। হতে পারে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় এ কারণে, দেশের ভেতর রাজনৈতিকশূন্যতা যখন থাকে, রাজনীতির মানুষগুলো দিশাহীন থাকে, তখন বিরাজনীতিকরণের শক্তিগুলো চড়াও হয়, সেখান থেকে একজন নেতৃত্ব বের হলে মানুষ সেটাকে গ্রহণ করে। নুরের ক্ষেত্রেও সেটি হয়েছে। জনগণের কাছে নুর প্রমাণ করেছেন, সরকার যতই দমন-পীড়ন চালাক, সফল হতে হলে মাটি কামড়ে থাকতে হবে, লেগে থাকতে হবে, এটা ছিল নুরের কায়দা। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল টার্গেট ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসূরিদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। নুর আন্দোলনের নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবচেয়ে বড় আঘাত করেছিলেন।

এটা সত্য, বিপুল সংখ্যক মানুষ নুরের মধ্যে বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পান। সরকারের বিরুদ্ধে সাহসী বক্তব্য আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করে। মানুষের ভেতর সহজে ঢুকে পড়েন নুর। কিন্তু নুর হতাশ করতে বেশি সময় নেননি। এরই মধ্যে নুর হতাশ করেছেন। নিজেকে ঢেকে রাখতে পারেননি তিনি। তার আসল চরিত্র প্রকাশ পেয়ে গেল একজন ধান্দাবাজ, চাঁন্দাবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে। আসলে নুর ভিলেজ পলিটিক্সের একজন প্রতিভূ। নিজে সদস্যসচিব হলেও গণ অধিকার পরিষদ মানেই নুরুল হক নুর। তিনি ইচ্ছামতো আহ্বায়ক পছন্দ করেন, আবার পছন্দ না হলেও বিদায় করে দেন। যদিও এসব বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি ধারার একটা অংশ। কিন্তু যারা ভেবেছিল নুরদের দল অন্যদের থেকে আলাদা, তাদের জন্য ছিল এটা বিরাট ভুল, তাদের বোকা বানিয়েছে তারা।

৫ বছর ধরে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে গণ অধিকার পরিষদ করেই কাটছেন নুর এবং তার সঙ্গীদের সময়। এই ৫ বছরে তাদের কোনো দৃশ্যমান পেশা নেই। অনেক সংগঠনের মতো নুরের দিন চলে জনগণের টাকায়, প্রবাসীদের টাকায়, যা এখন ওপেনসিক্রেট। কোটা সংস্কারের আন্দোলন করলেও নুর বা তার সংগঠনের শীর্ষনেতাদের কেউই সরকারি চাকরি বা অন্য কোনো চাকরিতে যাননি। রাজনীতির নামে চাঁদাবাজিই তাদের পেশা।

চার.

ছাত্র অধিকার পরিষদ আর গণ অধিকার পরিষদ বলেন; নুরুল হক নুরই সেখানে সর্বেসর্বা। ড. রেজা কিবরিয়া এখানে দুধভাত। তিনি মূলত উড়ে আসা জুড়ে বসা নেতা। গণফোরাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ দলে যুক্ত হন। আর ওই সময় নুর সংগঠন করতে একটা ক্লিন সাইনবোর্ড খুঁজছিলেন। অনেকের কাছে গিয়েছিলেন নুর, শেষ পর্যন্ত রেজা কিবরিয়াকে তার দলে টানলেন। তবে তাদের মিলনটা যতটা আনন্দের ছিল, বিচ্ছেদটা ততই বিষাদের। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল।

এ দুজন মিলে যে দলটি গড়ে তুলেছিলেন, শুরু থেকে সেটি নিয়ে রাজনীতিতে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছিল। নবীন গণ অধিকার পরিষদের বেলায় অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটেছে, পুরো দলটি গড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তাদের উত্থানের সময়টিতে বাংলাদেশে তীব্র রাজনৈতিক শূন্যতাও চলছিল। নুর ও তার সঙ্গীরা সেই চান্স খুঁজছিলেন, ওই সময়ের প্রতিবাদী ভূমিকা তাদের দিকে সামাজিক সহানুভূতির ঢেউ তৈরি করে। সবার ধারণা হয়েছিল তারা হয়তো রাজনীতিতে ভিন্ন কিছু ভাববেন, নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হবেন। তাদের সঙ্গে রেজা কিবরিয়ার মতো একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি, যার শরীরে শাহ এএমএস কিবরিয়ার মতো একজন পরিশীলিত মানুষের রক্ত বইছে। তারা হয়তো সত্যি সত্যি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে একটা নতুন ধারা, নতুন একটি বলয় তৈরি করতে পারবেন বলে মানুষের বিশ্বাস হয়েছিল। কিন্তু মানুষের এই ভ্রম ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি।

পাঁচ.

বাংলাদেশে রাজনীতি আসলে ‘টু পার্টি’ পলিটিক্সনির্ভর। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলয়ের সীমাবদ্ধ। আর জোটভিত্তিক নির্বাচনী রাজনীতির কারণে এ দুই দলের বাইরে তৃতীয় কোনো দলের এককভাবে শক্তিশালী হয়ে তৃতীয় শক্তি হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি।

‘থার্ড ফোর্স’ বা ‘তৃতীয় শক্তি’ শব্দগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু বছর ধরে চলে আসছে। বিশেষ করে দেশে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে অন্য কোনো দলের গঠন প্রশ্নে এই তৃতীয় শক্তির কথা সামনে আসে। কেউ কেউ মনে করে রাজনীতি তার নিজস্ব গতি ও স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললে অরাজনৈতিক শক্তি শূন্যতা পূরণের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে সেটিই তৃতীয় শক্তি।

এক-এগারোর আমলে ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওইসব সম্ভাব্য পার্টিকেও তখন তৃতীয় শক্তি হিসেবে মনে হয়েছিল। কিন্তু তারা আর হালে পানি পাননি।

ছয়.

ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে নুরের বিরুদ্ধে নানা সময়ে দলের টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। তার দলের নেতাকর্মীরাই এ অভিযোগ করেছেন। বিকাশ, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নুরের কাছে দলের টাকা আসে, এসব খবর এখন পুরনো। সেগুলোর কোনো হিসাব তিনি দলের কাছে দেন না। দেশ-বিদেশ থেকে আসা টাকা নিজে আত্মসাৎ করতে থাকেন। কোটা সংস্কারের সঙ্গে জড়িত তার দলে যোগ দেওয়া কয়েকজনকে বহিষ্কার করেন তিনি। তার দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলেও দেশের গণতন্ত্র চর্চার ছবক দিচ্ছেন। রেজা কিবরিয়াকে সামনে রেখে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের দূতাবাসগুলোর সঙ্গে সখ্য বাড়াতে থাকে নুর। তাকে বিশেষ একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কয়েক দফা মিটিং করতে দেখা যায়।

নুরুল হক নুর নিজেকে যতটা রাজনীতিবিদ হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যে জনগণের সম্পৃক্ততার পথ ধরে তার উত্থান, তার সঙ্গে জনগণের সেই সম্পর্ক আছে? কালেভদ্রে প্রেসক্লাবে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেওয়া আর বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনীতিকদের সঙ্গেই বৈঠক করে তার সময় কাটে। কিন্তু কূটনৈতিকদের চেয়ে গোয়েন্দারা তার বেশি পছন্দ।

বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ নুরুল হক নুর দুবাইয়ের ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কথিত এক এজেন্ট মেন্দির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকের ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত অভিযোগ করেছেন, মোসাদের এজেন্টের সঙ্গে বৈঠক একবার নয়, তিনবার হয়েছে। যে নুর মাঝে মাঝে ইসলামের পক্ষে এত আওয়াজ দেন, সে কিনা ‘মুসলমানদের দুশমন’ ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, এটা কীসের লক্ষণ? জামায়াত যেমন ইসলামের নামে অপরাজনীতি করে, ব্যবসা করে; নুরও খোলস পাল্টিয়ে সেদিকে যাচ্ছে, আরও ভয়ানকভাবে। আমাদের রাজনীতির অনেক সংকটকাল অতিক্রম করছি, কিন্তু নুরের তৎপরতা সে রাজনীতিকে আরও দূষিত করে তুলবে। সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *