বিরল একটি পরিযায়ী দিনেকানা (Nightjar) পাখির খোঁজে রাজশাহী শহরের কাছে পদ্মা নদীর এক চরের মাঠ চষে বেড়াচ্ছি। প্রচণ্ড গরমে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চরের তপ্ত আবহাওয়ায় ঘুরে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই বসার মতো একটু উঁচু জায়গা পেয়ে খানিকটা জিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। মাথা গামছায় ঢেকে ক্যামেরার ব্যাগে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছি। অতিরিক্ত গরমে কিছুটা ঝিমুনি এসে গেল। কিন্তু আধখোলা চোখে বাদামি রঙের কিছু একটা দৌড়ে যেতে দেখলাম যেন। তবে আশপাশটা ভালো করে দেখেও তেমন কিছু চোখে পড়ল না।
চুপচাপ বসে থাকলাম আরও মিনিট পাঁচেক। এরপর ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে দুরবিনের মতো করে প্রতি ইঞ্চি ঘাসের মধ্যে জিনিসটি খুঁজতে লাগলাম এবং দুই মিনিটের মধ্যেই আসামি পাকড়াও করে ফেললাম, অর্থাৎ যে বাদামি জিনিসটি দৌড়ে গিয়েছিল তাকে খুঁজে পেলাম। তবে সে আমাকে দেখে ফেলেছে বলেই তার দেহকে যথাসম্ভব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে এমনভাবে পেটের মাধ্যমে হেঁটে চলেছে, যেন ছোট ছোট ঘাস গলে আমি ওকে দেখতে না পাই। তার এই যে শিকারি বা শিকারি প্রাণী থেকে নিজেকে লুকিয়ে চলার কৌশল, সেটাই তাকে এতদিন ধরে এদেশের বুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তা না হলে মুরগি জাতীয় এই পাখিটির সুস্বাদু মাংসের লোভে কবে লোভাতুর মানুষের জিহ্বার খোরাক হয়ে যেত, আর বিলুপ্তির খাতায় নিজের নাম লেখাত। অবশ্য আইইউসিএন, বাংলাদেশ কর্তৃক ২০১৫ সালে প্রকাশিত লাল উপাত্ত বইয়ে পাখিটিকে এদেশে
আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত বলেই উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু বহুদিন লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকার পর ২০১৮ সালের ১৫ মে রাজশাহীর পদ্মার চরে হঠাৎ দেখা দিয়ে প্রমাণ করে দিল যে, এখনো ওরা এদেশের বুকে বেঁচে আছে।
সূত্রমতে, ১৮৫২ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ১৭১ বছর আগে বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির ক্যাপ্টেন আর সি টিটলার এদেশ থেকে পাখিটির একটি নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। এটাই ছিল এদেশে এই পাখিটি দেখার শেষ তথ্য। রাজশাহীতে ২০১৮ সালের ১৫ মে প্রথম দেখা যাওয়ার পর ২৭ মে চুয়াডাঙ্গায় এবং ১৫ জুলাই কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন হরিপুরেও দেখা গিয়েছিল। আর আমি পাখিটিকে রাজশাহীর পদ্মার চরে দেখি ২০১৮ সালের ৩০ জুন। এরপর ২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দেখলাম ভারতের রাজস্থানের ‘সারিস্কা টাইগার রিজার্ভ’, ৯ ফেব্রুয়ারি ‘র্যানথামবোর জাতীয় উদ্যান’ এবং ১১-১২ ফেব্রুয়ারি ‘ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্য’-এ খুব কাছ থেকে। কিন্তু এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ওকে রাজশাহীতে যেভাবে দেখলাম, সেভাবে আর কোনোদিনও কোথাও দেখিনি। মান-প্রাণ ভরে আলাদা আলাদাভাবে তিনটি পাখির ছবি তুললাম।
এতক্ষণ অতি সতর্ক মুরগি জাতীয় যে পাখির কথা বললাম সে আর কেউ নয়, এদেশের অতি বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় এক আবাসিক পাখি খৈর বা তিতির। ইংরেজি নাম Grey Francolin বা Grey Partridge। ফ্যাসিয়ানিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Francolinus pondicerianus। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং ইরানেও পাখিটির দেখা মেলে।
একনজরে খৈর খাটো লেজের বাদামি-ধূসর ডোরাযুক্ত পাখি। দৈর্ঘ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ২৯-৩৫ সেন্টিমিটার ও স্ত্রী ২৬-৩০ সেন্টিমিটার। ওজনে পুরুষ ২৫৫-৪১৮ গ্রাম ও স্ত্রী ২০০-৩৬৫ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষের চেহারায় পার্থক্য নেই। পুরুষের পায়ের নালায় (Shank) দুটি যুদ্ধাস্ত্র থাকে, যা স্ত্রীর নেই। পিঠের ডোরা পীতাভ, তামাটে, ধূসর-বাদামি ও বাদামি। বুক, পেট ও লেজতলের ডোরাগুলো কালচে-বাদামি। মাথা, গলা ও মুখ অনুজ্জ্বল কমলা-বাদামি। ঘাড় লালচে-হলদে। গলার নিচে স্পষ্ট কালো মালার মতো থাকে। চোখ পিঙ্গল-বাদামি ও চক্ষুরেখা কালো। চঞ্চু রুপালি, যার আগা কালো। পা ও আঙুল অনুজ্জ্বল লাল।
খৈর শুষ্ক ঘাসবন, ঝোপঝাড়, কৃষি খামার ও বালুতটে বিচরণ করে। সচরাচর ৪-৮টির ছোট দলে থাকে। ওরা দিবাচর, ভূচারি ও যুথচারি (Gregarious)। চঞ্চু ও পায়ের নখ দিয়ে মাটি আঁচড়ে খাবার খোঁজে। মূলত পোকামাকড়, ঘাসবিচি, আগাছাবীজ, শস্যদানা, ঘাসের গোড়া, রসালো ফল ইত্যাদি খায়। রাতে ছোট কাঁটাগাছ বা ঘন ঝোপের নিচে আশ্রয় নেয়। সচরাচর ‘কিলা-কিলা—’, ‘কাটিলা-কাটিলা—’, ‘কা-টি-তার–টি-তার—’ বা ‘খির্র-খির্র—’ শব্দে ডাকে।
এপ্রিল থেকে আগস্ট প্রজনন মৌসুম। এ সময় ওরা কাঁটাঘেরা ঝোপ বা পাথরের ফাঁকে ঘাস-লতা-পাতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৬ থেকে ৯টি, রং লালচে বা হলদে, তার ওপর থাকে গাঢ় বাদামি দাগছোপ। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৮-১৯ দিনে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।
লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর
Source link