আমেরিকান সংস্থা কেয়ার থেকে ১৯৬৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ২৪ জনের একটা টিম কুষ্টিয়ার উদ্দেশে পাঠানো হয়। ২০ মিনিট পর হেলিকপ্টারটির ফরিদপুরে নামার কথা ছিল। কিন্তু মাটি ছোঁয়ার আগেই সেটি বিধ্বস্ত হয়। ২৪ যাত্রীর ২৩ জনই ওই দুর্ঘটনায় নিহত হন। বেঁচে ফেরেন শুধু একজন।
তখন তিনি চাকরি করতেন কেয়ারে। হেলিকপ্টারটি ছিল পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ)। এটির মালিক ছিলেন আজগর খান, যিনি পাকিস্তানের একজন বড় রাজনীতিক ছিলেন। তাকে হাসপাতালে দেখতেও গিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে তিনি পিআইএর ঢাকা অফিসে চাকরির আশায় যান। পিআইএ কর্তৃপক্ষ তাকে তাদের অফিসে চাকরি দেয়।
পিআইএর চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসেস (সিএসএস) পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষায় তিনি পুরো পাকিস্তানে ১৩তম এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। তার নাম এমএ মান্নান। এখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী।
সুনামগঞ্জের এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই অভাবের সঙ্গে লড়েছেন। পাকিস্তানের সারগোদা বিমান বাহিনী স্কুলে ভর্তি, অর্থাভাবে এইচএসসি পাসের পর পড়াশোনা বন্ধ, নদীর পানি পান করে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা অন্যরকম জীবন তার। একদিকে জীবনযুদ্ধ, অন্যদিকে সফলতা।
এমএ মান্নান বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী হলেও তিনি তার শিকড় ভুলে যাননি। এখনো তিনি গর্ব করে বলতে পছন্দ করেন, ‘আমি গরিব ও অভাবী পরিবারের সন্তান।’ সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ডুংরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম তার। ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে তিনি পরিচিত।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান তার বাবার রেখে যাওয়া ভিটেমাটি ট্রাস্ট করে দিয়েছেন। সেখানে তার প্রয়াত মা আজিজুন নেসার নামে একটা টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট করেছেন। বাবার ভিটেতে ৩০ শতাংশ জায়গা ছিল, পরে তিনি আরও ১৬ শতাংশ জায়গা কিনেছিলেন। মোট ৪৬ শতাংশ জমিতে টেক্সটাইল কলেজ নির্মাণ করেছেন। সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
এমএ মান্নান সরকারের সফল আমলা ছিলেন। যুগ্ম সচিব থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতিতে যুক্ত হন। আমাদের দেশে যারা আমলা থেকে মন্ত্রী হন, তারা সাধারণত জনগণের এমপি-মন্ত্রী হতে পারেন না। তারা মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন না। সবসময় একটা ব্যবধান থাকে।
‘আপনার ক্ষেত্রে তা হয়নি কেন?’ এ প্রশ্নের জবাবে এমএ মান্নান বলেন, ‘আমি গ্রামের খুব সাধারণ একটা পরিবারে জন্মেছি। সুনামগঞ্জের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমি বেড়ে উঠেছি। আমি এমন কোনো পরিবারে জন্ম নিইনি, যেখানে মানুষের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। তাই সবসময় সাধারণ মানুষের জন্য আমার মন কাঁদে। আমি জন্মগতভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করি, তাদের সুখ-দুঃখ কাছ থেকে দেখতে চাই, তাদের কথা শুনতে চাই। আমি এখন মন্ত্রী, তারপরও আমি চাই প্রান্তিক মানুষের কাছাকাছি যেতে। যদিও নানা কারণে পুরোপুরি তা করে উঠতে পারি না।’
আমলা ও রাজনীতিকÑ দুই জীবনেই সফল। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি খুব কষ্টের কাজ। এতে যেমন কায়িক পরিশ্রম হয়, তেমনি মানসিক পরিশ্রমও হয়। তারপরও বাকিটা জীবন রাজনীতি করেই কাটাতে চাই।’
বিপরীতে আমলাদের জীবন একটা আবদ্ধ জীবন। আইন মেনে, নিয়ম মেনে বসের অধীনে জীবন চালাতে হয়। তিনি বলেন, ‘সরকারে আমার বস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি কিন্তু তার পাশে বসে কাজ করতে পারি। অথচ আমলা থাকতে আমি চাইলেও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে যেতে পারতাম না, বসা তো দূরের কথা।’
তার রাজনীতিতে আসার প্রেক্ষাপটটা সহজ ছিল না। তিনি যে আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন, সেটা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেক কিংবদন্তি আবদুস সামাদ আজাদের আসন।
আমাদের দেশে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের কোনো সদস্যকেই এমপি বানানোর রীতি। এ রীতির বিপরীতে গিয়ে কীভাবে নমিনেশন পেলেন জানতে চাইলে এমএ মান্নান বলেন, ‘আবদুস সামাদ আজাদ মারা যান ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল। এরপর উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। তখন আমি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। কিন্তু শেখ হাসিনা জানান, আওয়ামী লীগ জোট সরকারের অধীনে ভোট বর্জন করেছে, তাই দল থেকে প্রার্থী করার সুযোগ নেই। তবে আমি যদি স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে চাই, তাহলে নেত্রী আমার জন্য দোয়া করবেন।’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমি এলাকায় যাই এবং মানুষের সঙ্গে কথা বলি। ব্যাপক সাড়া পাই। আমি নির্বাচনে অংশ নিই। কিন্তু সেই নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমাকে সহযোগিতা করেননি। উল্টো বলেন, আমি উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছি। তারপরও আমি নির্বাচন করি। সেই নির্বাচনে মাত্র তিন হাজার ভোটে আমি হারলাম বা আমাকে হারানো হলো। সেই নির্বাচনে জোট সরকারের প্রার্থী ছিলেন শাহিনুর পাশা চৌধুরী। তাকে জেতানোর জন্য মান্নান ভূঁইয়া, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রমুখ বিএনপি নেতা জগন্নাথপুর-শান্তিগঞ্জে আমার নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে প্রচারণা চালান।’
ছোটবেলায় নদীর পানি খেয়ে এমএ মান্নান কলেরায় আক্রান্ত হলেও বেঁচে যান। তবে কলেরায় তার ছোট ভাইবোন মারা যায়। এরপর তিনি মামার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার ধারনে চলে যান। সেখানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় জানতে পারেন, পাকিস্তানের সারগোদা বিমান বাহিনীর স্কুলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির আবেদন নেওয়া হচ্ছে। তিনি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পান এবং ‘ও’ লেভেল পাস করেন। সেখানে পড়াশোনার খরচ বহন করত সরকার। সেখানে তিনি দেখলেন, তার সহপাঠীদের অধিকাংশই পাকিস্তানের ধনী পরিবারের সন্তান। তাদের ভাষা আলাদা, স্বভাবচরিত্র, চলাফেরা, খাবারদাবার আলাদা। সেখানে পড়াশোনার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। শিক্ষকদের অধিকাংশ ছিলেন ব্রিটিশ।
তিনি বলেন, ‘আমি গ্রামের ছেলে; নিম্ন আয়ের পরিবারে মানুষ হওয়ায় আমার চালচলন আলাদা এটা আমি বুঝতে পারি। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যারা গিয়েছিল ওই বিদ্যালয়ে, তারাও অর্থনৈতিক বিচারে আমার চেয়ে উচ্চমর্যাদার ছিল। তাদের বাবারা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। সারগোদাতে আমার সহপাঠীদের অনেকেই পরে পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে বড় চাকরি করেন। পাকিস্তানি অনেক বন্ধু পরে সে দেশে মেজর, চিফ অব স্টাফ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সঙ্গে এখনো মাঝেমধ্যে আমার যোগাযোগ হয়।’
সারগোদাতে ও লেভেল সম্পন্ন করার পর সহপাঠীদের সঙ্গে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষায় রেজাল্ট নেগেটিভ আসায় বিমান বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। তাকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আবার শুরু হয় কষ্টের দিন।
বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে) ফিরে এসে ঢাকার একটা মেসে ওঠেন। তার এক মামার সহযোগিতায় একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু মেসের খরচ জোগাতে না পেরে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। এরপর একটা ক্লিয়ারিং এজেন্সিতে চাকরি নেন। সেখান থেকে আমেরিকান সংস্থা কেয়ারের ঢাকা অফিসে চাকরি পান। কেয়ারে থাকা অবস্থায় ওই ভয়ানক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পড়েন।
অবসর সময় কীভাবে কাটে এ প্রশ্নের জবাবে এমএ মান্নান বলেন, ‘আমার জীবনে অবসর সময় খুব কম। আগে বই পড়তাম। ইদানীং এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, বই পড়ার সময় পাই না। বই পড়তে বসলাম তো কেউ কল দিয়ে বসল! মিটিং, সভা-সেমিনার, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনÑ এসব করতে গিয়ে একদম অবসর সময় পাওয়া যায় না।’
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘তবে আমি প্রচুর গান শুনি। হয়তো গাড়িতে কোথাও যাচ্ছি, আমি আমার মোবাইলে গান ছেড়ে দিই। যখনই সুযোগ পাই আমি গান শুনি। শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসংগীত শুনি। আমার বাড়ি যেহেতু হাওর অঞ্চলে আবদুল করিম, হাছন রাজা, রাধারমণের গান আমার এমনিতেই প্রিয়। কিছু আধুনিক গানও মাঝেমধ্যে শোনা হয়।’
প্রেমিক হিসেবে কেমন ছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কম বয়সে এমনিই প্রেম হয়ে যেত। ওই সময়ে প্রেমের জন্য বিশেষ পরিবেশ লাগত না। আশপাশে হাঁটলেই প্রেম হয়ে যেত।’
ঢাকায় একদিন দেখা হয় জুলেখা মান্নানের সঙ্গে। এরপর পরিচয়-প্রেম-বিয়ে। তারপর সংসার। অকপটে বললেন মন্ত্রী এমএ মান্নান।
Source link