যেসব প্রাকৃতিক সম্পদ একবার নিঃশেষ হয়ে গেলে আর পাওয়া যায় না, সেগুলোকে বলে অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক গ্যাস সেরকম একটি অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ।
গেল সপ্তাহে গণমাধ্যমগুলোয় আমাদের এ প্রাকৃতিক সম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, এর পাশাপাশি আশান্বিত হওয়ার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এর কিছুটা এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করতে চাই।
উদ্বেগের কারণটি ছিল বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে। দেশে গ্যাস উৎপাদনে পেট্রোবাংলার তালিকায় রয়েছে সর্বমোট ২২টি গ্যাসফিল্ড। এর মধ্যে চারটির উৎপাদন নেই বললেই চলে। বাদবাকি ১৮টি গ্যাসফিল্ডের মধ্যে বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডই সবচেয়ে বড়। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় ১৯৯৮ সালে এ বৃহৎ গ্যাসফিল্ড আবিষ্কৃত হয়।
ফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব পায় মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। এ গ্যাসফিল্ড থেকে প্রথমবারের মতো গ্যাস উত্তোলন করা হয় ২০১৭ সালে। এরপর থেকে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে এ ফিল্ড থেকে ২৬টি কূপের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আবিষ্কারের সময় বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডের মজুত প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫ হাজার ৭৫৫ বিলিয়ন কিউবিক ফিট (বিসিএফ) গ্যাস।
বিগত বছরগুলোয় এ গ্যাসফিল্ড থেকে মোট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫০১ বিসিএফ গ্যাস। আর মজুত আছে মাত্র ২৫৪ বিসিএফ গ্যাস।
প্রথমদিকে উত্তোলনের পরিমাণ বেশি থাকলেও ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ক্ষেত্রটি থেকে দৈনিক গড়ে ১ দশমিক ১৫ বিসিএফ পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসাবে মজুতকৃত গ্যাস দিয়ে আর মাত্র ২২০ দিন সরবরাহ প্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
বিবিয়ানার গ্যাসফিল্ড নিয়ে আমাদের আগ্রহের অনেক কারণ আছে। আমাদের দেশে গ্যাস ও আমদানিকৃত এলএনজি মিলে দৈনিক সরবরাহের পরিমাণ ৩ বিসিএফের কিছু বেশি, যদিও চাহিদা রয়েছে ৪ বিসিএফের। এই মোট সরবরাহের প্রায় ৩৮ শতাংশের জোগান দেয় বিবিয়ানা। গত কয়েকদিনে মোট চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ০.৪-০.৫ বিসিএফ কমে গেছে। এ অবস্থায় বিবিয়ানার উৎপাদন হঠাৎ কমে গেলে আগামী দিনে সরবরাহ চেইনের সমস্যার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমামের ভাষ্য হলো : দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার গ্যাস উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। এ গ্যাসফিল্ডের গ্যাসের মজুতও কমে এসেছে। বৃহৎ এ ফিল্ডের উৎপাদন আকস্মিকভাবে কমে গেলে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের জোগান কীভাবে হবে সেটি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ও সংশয় রয়েছে। পেট্রোবাংলা বা জ্বালানি বিভাগের পরিকল্পনায় এত বড় গ্যাসফিল্ডের উৎপাদন কমে গেলে এর বিপরীতে জোগান কীভাবে হবে, এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। দেশের গ্যাসগ্রিড থেকে বৃহৎ একটি গ্যাসফিল্ডের উৎপাদনে বিঘ্নতা সৃষ্টি হলে তা শিল্পে ও বিদ্যুতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
কোনো গ্যাসফিল্ডের গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কোথাও গ্যাসের মজুত অসীম নয়, বরং খুবই সীমিত। কোনো গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস কতদিনে ফুরিয়ে যাবে, তা নির্ভর করে দৈনিক কী পরিমাণ উত্তোলন করা হচ্ছে তার ওপর। উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে বিবিয়ানা থেকে আগামী ৫ বছরও গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, এ ঘাটতি পূরণে এলএনজির আমদানি বাড়াতে হবে। আর এলএনজির আমদানি বাড়াতে হলে ডলারের সংস্থান করতে হবে। সমস্যাটি তাই আর্থিক সীমায় আবদ্ধ।
গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারকে দায়ী করছি না; কিন্তু ফুরিয়ে গেলে কোথা থেকে সরবরাহ করা হবে, এ বিষয়ে পরিষ্কার পরিকল্পনা প্রত্যাশা করি। কারণ, আমাদের বর্তমান মোট মজুত থেকে চাহিদার তুলনায় স্বল্প পরিমাণে গ্যাস উত্তোলন করা হলেও আগামী এক দশকে সব গ্যাস ফুরিয়ে যাবে।
১৫ জুন জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তেমনটিই জানান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নতুন আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র ইলিশার মজুতসহ দেশে বর্তমানে গ্যাসের প্রাথমিক মজুতের পরিমাণ ৪০ দশমিক ৪৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। আমাদের উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত ২৮ দশমিক ৭৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ১৯ দশমিক ৯৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ৮ দশমিক ৮২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট মজুত অবশিষ্ট আছে। প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ২.২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের কথা বলা হয়েছে, যা চাহিদার প্রায় ৬৫ শতাংশ।
তাহলে বছরে উত্তোলন করা যাবে ৮০৩ বিলিয়ন গ্যাস। মজুত আছে ৮ দশমিক ৮২ ট্রিলিয়ন বা ৮ হাজার ৮২০ বিসিএফ, যা দিয়ে ১০ বছরের কিছু বেশি সময় চলা যাবে। এ অবস্থায় সরকারও এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে। কেননা, সরকার মনে করছে, আগামী বছরগুলোয় গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ২২ মার্চ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সাংবাদিকদের তেমনটিই জানান দিয়েছেন।
এ মুহূর্তে নতুন কোনো গ্যাসফিল্ড আবিষ্কার হলেও তা থেকে সরবরাহ পেতে ৩ বছর সময় লাগবে। আর গভীর সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে সরবরাহ করতে সময় লাগবে ৮ থেকে ১০ বছর। সুতরাং, সরকার এলএনজি আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য নতুন টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে ভাসমান দুটি টার্মিনাল আছে মহেশখালীতে। এ দুটি টার্মিনালে সর্বোচ্চ সরবরাহ সক্ষমতা দিনে ১ বিসিএফ হলেও সরবরাহ করতে পারে ০.৮৫ বিসিএফ। এর সঙ্গে যুক্ত হবে পায়রা এবং মহেশখালীতে নতুন দুটি ভাসমান টার্মিনাল। এছাড়া মহেশখালীতে স্থলভাগে প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।
গ্যাস ব্যবহার করলে একদিন তা ফুরিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকতে হবে। এ সরল অঙ্কটা আমরা কমবেশি সবাই বুঝি। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, পুরোমাত্রায় আমদানিনির্ভরতার কোনো বিকল্প আছে কি না। আমরা মনে করি, আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। সংবাদমাধ্যম বলছে, ২০১৭ সালে দেশে গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে গিয়ে ডেনমার্কের প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র্যাম্বল এক প্রক্ষেপণে বলেছিল, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশে চাহিদা পূরণে গ্যাস আমদানিতে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। আমদানিনির্ভর না থেকে এ অর্থ যদি স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উন্নয়নে কাজে লাগানো হয়, তাহলে এ থেকে সুফল পাওয়া যাবে অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞদের প্রক্ষেপণের প্রমাণ মিলেছে। অতিসম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে দেশের ২৯তম গ্যাসক্ষেত্র ভোলার ইলিশায়। এ অনুসন্ধানের কাজটি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। দেশে অনুসন্ধানের কাজ দীর্ঘদিন স্থবির ছিল। সাধারণত গ্যাস অনুসন্ধানে একটি গ্যাসকূপ খনন থেকে শুরু করে গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত ৩ থেকে ৫ মাস সময় লাগে। কিন্তু ইলিশা-১ কূপটি খনন করে গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সময় লেগেছে মাত্র ১ মাস ১৬ দিন। ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে মজুতের পরিমাণ ২০০ বিসিএফ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ের গ্যাস বিক্রির মূল্য বিবেচনায় মজুতকৃত গ্যাসের আর্থিক মূল্য ৬ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে আমদানিকৃত এলএনজির দাম হিসাব করলে ইলিশায় পাওয়া গ্যাসের মূল্য প্রায় ২৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে গিয়ে বাপেক্সের ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৯০ কোটি টাকা। জ্বালানি বিভাগের হিসাব বলছে, ভোলার শাহবাজপুর, ভোলা নর্থ ও ইলিশা মিলে ২ দশমিক ২৩ টিসিএফ (যা ইলিশায় আবিষ্কৃত গ্যাস মজুতের ১১ গুণের সমান) গ্যাসের মজুত রয়েছে।
সুতরাং, অনুসন্ধান কাজের ব্যয় প্রাপ্তির তুলনায় অতি সামান্য। তাই এলএনজি আমদানির পাশাপাশি দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদদের মতামত দিয়েই শেষ করব : কূপ খনন করলেই যে গ্যাস পাওয়া যাবে, তা আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। ইলিশায় গ্যাস পাওয়া এর বড় প্রমাণ। কেউ কেউ মনে করেন, দেশে গ্যাস নেই। আসলে তা সঠিক নয়। আমরা আরও কূপ খনন ও জরিপ চালালে গ্যাস পাব। আর গ্যাস পেলে যে পরিমাণ অর্থে এলএনজি আমদানি করছি, তার খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারব। একটি আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতির ওপর ভরসা করে আমরা বসে থাকতে পারি না।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
Source link