কারও দেখা ব্যাডমিন্টন কোর্টে। কারও দেখা হয়েছিল সাঁতারের পুলে। আবার কোনো কোনো জুটির যুগল যাত্রা শুরু হয়েছিল তির-ধনুকের লক্ষ্যভেদের খেলায়। পছন্দ থেকে প্রণয়, প্রণয় থেকে পরিণয়। হৃদয়ের লেনদেনের সফল পরিণতিতে খেলার মাঠ থেকে জীবনের জুটি হয়েছেন অনেকেই। ক্রীড়াবিদদের প্রেম-পরিণয় এবং ঘর বাঁধা নতুন কিছু নয়। তবে বিষয়টা যে খুব হরহামেশা দেখা যায় তা-ও কিন্তু নয়। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের এমন কিছু জুটির গল্প নিয়ে এই প্রতিবেদন।
রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী (আরচারি)
আন্তর্জাতিক আাচারিতে নিয়মিত জুটি গড়েন রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডে আরচারি বিশ্বকাপে জুটি বেঁধে রুপাও জিতেছেন দুজনে। রোমান-দিয়ার এই রসায়ন খেলার মাঠেই আর সীমাবদ্ধ নেই। তারা এখন জীবনসঙ্গী। এক তিরে বিঁধেছে নিজেদের জীবনরেখা। ৫ জুলাই তাদের ভালোবাসার সফল পরিণয় হয়েছে।
সুলতানা পারভীন লাভলী (অ্যাথলেট) ও কামরুজ্জামান সেলিম (ফুটবলার)
দেশের অ্যাথলেটিক্স অঙ্গনে সুপরিচিত নাম সুলতানা পারভীন লাভলী। একসময় ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ১০০ ও ৪০০ মিটার রিলেতে ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী। সাতবার দেশের দ্রুততম মানবীও হয়েছিলেন লাভলী। ঠিক ওই সময়ে কামরুজ্জামান সেলিম ছিলেন দেশের ফুটবলের অন্যতম বড় নাম। অগ্রণী ব্যাংক ক্লাবে খেলেছেন। পরে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানের সাদা-কালো জার্সিতেও খেলেন। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে প্রায়ই যেতেন লাভলী। সেখানেই দেখা হয় দুজনের। এরপর ভালোবাসা। ২০০০ সালে বিয়ে করেন তারা। এখন এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সংসার তাদের।
আবুল হাশেম ও কামরুন নাহার ডানা (ব্যাডমিন্টন)
ক্রীড়াবিদদের প্রেম ও বিয়ের কথা বললে প্রথমেই আসবে ব্যাডমিন্টন তারকা কামরুন নাহার ডানা ও আবুল হাশেম জুটির কথা। ১৯৭৯ সালে ব্যাডমিন্টনে প্রথম জাতীয় শিরোপা জেতেন ১৯৬০ সালে জন্ম নেওয়া ডানা। তিনি মনোয়ার উল আলম বাবুলের সঙ্গে মিশ্র দ্বৈতে এই শিরোপা জিতেছিলেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি আরও ১২টি শিরোপা জেতেন। নারী এককে তিনবার, দ্বৈতে চারবার এবং মিশ্র দ্বৈতে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হন ডানা। ১৯৮৫ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন আরেক সাবেক জাতীয় তারকা শাটলার আবুল হাশেমকে। দুই সন্তান নিয়ে দিব্বি সংসার করে চলেছেন রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়া সাবেক দুই শাটলার।
সাইফুল আলম রিংকি ও সাবরিনা সুলতানা (শুটিং)
ক্রীড়াঙ্গনে আরও একটি জুটি বেশ পরিচিত। শুটিং জগতের দুই তারকা সাইফুল আলম রিংকি ও সাবরিনা সুলতানা। ২০০৩ সালে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন এই দুই শুটার। দেশ ছেড়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রে আগাসির শহর লাস ভেগাসে ছিলেন অনেকদিন। এখন অবশ্য ফিরে এসেছেন দেশে। দুই ছেলেকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার।
ফিরোজ হোসেন পাখি ও লাভলী চৌধুরী আঁখি (শুটিং)
শুটিং রেঞ্জেই হৃদয়ের লেনদেন সেরেছিলেন ফিরোজ আহমেদ পাখি ও লাভলী চৌধুরী আঁখি। সেই ভালোবাসা পরিণয় পায় ২০০০ সালে। ভালোবাসার সংসারে একটি মেয়েও ছিল তাদের। কিন্তু ২০১২ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আইমাড়ি ব্রিজ এলাকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ফিরোজ আহমেদ পাখি ও তার মেয়ে পুষ্পিতা। সৌভাগ্যক্রমে লাভলী বেঁচে যান।
মো. ইসমাইল ও তামান্না আক্তার (অ্যাথলেটিক্স)
অ্যাথলেটিক্সের আরেক সফল জুটি ইসমাইল হোসেন ও তামান্না আক্তার। ট্র্যাকেই পরিচয়। চার বছরের ভালো লাগার সম্পর্কের পরিণতিতে দুই পরিবারের সম্মতিতে গত বছর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তারা। ইসমাইল দেশের চারবারের দ্রুততম মানব। বাংলাদেশ গেমসেও সোনা জিতেছেন। লংজাম্পে ইসমাইল নয়বারের সোনাজয়ী। তামান্না নিয়মিত অংশ নেন ১০০ মিটার ও ৪০০ মিটার হার্ডলসে। জাতীয় ও সামার মিট মিলিয়ে ১০০ মিটার হার্ডলসে টানা ছয়বার সোনা জিতেছেন তামান্না।
শাহজাহান আলী রনি ও মাহফুজা আক্তার শীলা (সাঁতার)
সাঁতারে সম্ভাবনা জাগিয়েও ইনজুরির কারণে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি শাহজাহান আলী রনি। ২০০৬ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে স্বর্ণ জিতেছিলেন তিনি। অন্যদিকে মাহফুজা আক্তার শীলা ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে ভারতের আসামের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে জেতেন দুটি স্বর্ণপদক। ২০১৬ সালে পুলের সঙ্গী থেকে জীবনসঙ্গী হন এই দুই সাঁতারু।
হাসান উল্লাহ রানা ও রাশিদা (হ্যান্ডবল)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন থেকেই তাদের চেনাজানা। তবে তা ঋদ্ধ হয় হ্যান্ডবল কোর্টে এসে। সাবেক দুই হ্যান্ডবল খেলোয়াড় সংসার পেতে এখনো নটআউট। এক ছেলেকে নিয়ে দিব্বি কেটে যাচ্ছে বর্তমানে এই দুই সাংবাদিকের জীবন।
মিলজার হোসেন ও রেহেনা পারভীন (অ্যাথলেটিক্স)
দুজনই ছিলেন দেশের তারকা অ্যাথলেট। মিলজার হোসেন ৪০০, ৮০০ মিটার স্প্রিন্টে ছিলেন গতির রাজা। ১৯৮৫ ঢাকা সাউথ এশিয়ান গেমসে ৪০০ মিটারে রুপা জেতেন। ১৯৮৯ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সলিডারিটি গেমস ৮০০ মিটারে রুপা ও ৪০০ মিটারে ব্রোঞ্জ জেতেন। এশিয়ান গেমসের ৮০০ মিটারে সেরা পাঁচে ছিলেন মিলজার। আর এশিয়ান ইয়ুথ অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে জেতেন একটি করে রুপা ও ব্রোঞ্জ। রেহেনা পারভীন তখন ১০০ ও ২০০ মিটারে অন্যতম দেশসেরা অ্যাথলেট। অ্যাথলেটিক্সের এই জুটি ১৯৯৫ সালে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে রয়েছে এক ছেলে ও এক মেয়ে।
ইশরাত দিনা ও কামরুল ইসলাম কিরন (হ্যান্ডবল)
হ্যান্ডবলে আরেকটি জুটি রয়েছে। কামরুল ইসলাম কিরন খেলেছেন আশি ও নব্বইয়ের দশকে। পরে কোচিং পেশা বেছে নেন। তারই কোচিংয়ে খেলতে আসা ইশরাত জাহান দিনাকে ভালো লেগে যায়। দুজন বিয়ে করেন ২০০৪ সালে। তাদের সংসারে দুই ছেলে।
মোহাম্মদ আলী ও সোমা (টেবিল টেনিস)
আশির দশকের তুখোড় টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। খেলা ও কোচিং সমানতালে চালাতেন। আলীর কাছে টেবিল টেনিস শিখতে আসতেন সোনম সুলতানা সোমা। নড়াইলের মিষ্টি মেয়েকে দেখেই প্রেমে পড়ে যান মোহাম্মদ আলী। সেই পছন্দ বিয়েতে রূপ নেয় ২০০৪ সালে। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে তাদের সংসার।
মাহবুব বিল্লাহ ও মৌমিতা রুমি (টেবিল টেনিস)
টেবিল টেনিসের আরেক জুটিও ঘর বেঁধেছিলেন ভালোবেসে। সাবেক দুই জাতীয় টিটি চ্যাম্পিয়ন খন্দকার মাহবুব বিল্লাহ ও মৌমিতা আলম রুমি বেশ কবছর আগে বিয়ে করেছিলেন। তবে তা টেকেনি বেশিদিন। দুজনের মনের মিল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আলাদা হয়ে যান তারা।
এনায়েত উল্লাহ ও এলিনা সুলতানা (ব্যাডমিন্টন)
ব্যাডমিন্টনে একসময়কার সেরা দুই তারকা এনায়েত উল্লাহ খান ও এলিনা সুলতানা। এনায়েত র্যাংকিং ও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে নয়বারের চ্যাম্পিয়ন এবং ১৭ বারের চ্যাম্পিয়ন এলিনা সুলতানা। ব্যাডমিন্টন কোর্টেই তাদের পরিচয়। এরপর তা বিয়েতে গড়ায় ২০১১ সালে। তাদের সংসারে এখন এক মেয়ে ও এক ছেলে।
অহিদুজ্জামান রাজু ও শাপলা আক্তার (ব্যাডমিন্টন)
ব্যাডমিন্টনের আরেক জুটি অহিদুজ্জামান রাজু ও শাপলা আক্তার। শাপলা আক্তার সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। রাজুই প্রথম পছন্দ করেন শাপলাকে। পরে ২০১৬ সালে দুজনে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এক মেয়ে আমিরা বিনতে ওয়াহিদকে নিয়ে তাদের সংসার।
হোসেন খান ও হুমায়রা অন্তরা (কারাতে)
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ওস্তাদ কারাতেকারা। ২০১০ সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন হোসেন খান মুন। এখন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপির) একজন প্রশিক্ষক। অন্যদিকে ২০১৯ সালে নেপাল এসএ গেমসে স্বর্ণ জেতেন আরেক কারাতেকা হুমায়রা আক্তার অন্তরা। এই দুই কারাতেকার চার হাত এক হয় ২০২০ সালে।
মাহবুবুর রহমান লিটু ও মাহমুদা আক্তার অনন্যা (ফুটবল)
ফুটবল ভালোবাসতেন। মাঠে খেলতেনও। নামজাদা ফুটবলার হয়তো ছিলেন না। তবে সবুজ ঘাসের মাঠ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠত তাদের ভালোলাগা, ভালোবাসায়। ২০১১ সালে দুজনের বিয়ে হয়। সংসারে দুই মেয়ে। ঘর-সংসার সামলে এখনো জাতীয় নারী দলে কোচিংয়ের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এই দুই সাবেক ফুটবলার।
(চলবে)
Source link