‘এখানে সবাই দ্রুত ফল চায়’
‘এখানে সবাই দ্রুত ফল চায়’

সারা বিশ্বে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে। কীটতত্ত্ববিদরা এ কাজে নেতৃত্ব দেন। গবেষণা করে মশার বিস্তারের নানা দিক খুঁজে বের করা হয়। এরপর কাজে নামে কর্মীবাহিনী।

কিন্তু বাংলাদেশে পুরো উল্টো চিত্র। সিটি করপোরেশনগুলোতে কীটতত্ত্ববিদ নেই, গবেষণাগার নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সক্ষমতাই গড়ে ওঠেনি। এই সুযোগে মশা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চলছে। এর চরম খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় অনুসরণ না করেই মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলছে। এতে সুফল মেলার আশা করা যায় না।’

তিনি বলেন, ২০১৯ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। সেবার প্রথম ছয় মাসে আক্রান্ত ছিল ২২২ জন। আর এবার প্রথম ছয় মাসে আক্রান্ত ৯ হাজারের বেশি। ইতিমধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘আউট অব কন্ট্রোল’। সিটি করপোরেশনের জোড়াতালির কাজে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখবে না বলে মনে করেন ড. মঞ্জুর আহমেদ।

মশা নিয়ন্ত্রণকাজের সঙ্গে পেশাজীবী কীটতত্ত্ববিদ সম্পৃক্ত তা জরুরি হলেও ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। এখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাতজন এমবিবিএস পাস চিকিৎসক। সঙ্গে রয়েছে ১ হাজার ৫০ জন মশককর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক। নেই নিজস্ব গবেষণাগার। মশক নিধন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। কিন্তু কোনো বছর কোন কোন এলাকায় কী ধরনের মশার প্রজনন ঘটছে, তা চিহ্নিত করতে পারছেন না তারা। এ কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অনেকটা অন্ধকারে ঢিল মারার মতো ব্যাপার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে একজন কীটতত্ত্ববিদ ও ১৩ জন এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক দিয়ে। এই টিমকে সহায়তা দিচ্ছে প্রায় ৮০০ জন মশককর্মী। তাদেরও নেই নিজস্ব গবেষণাগার। কাজ চালাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে সেখানে কিছু গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।

স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সরকারি সফরে এখন দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছেন। টেলিফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, মশা নিয়ন্ত্রণকাজ বিজ্ঞানভিত্তিক হলেও জোড়াতালি দিয়ে কীভাবে সম্ভব? জবাবে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়েই মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারও সেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এটা সত্য, সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। সেটা পূরণের চেষ্টা চলছে। আর দেশব্যাপী মশা নয় কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সে বিষয়ে এটি খসড়া নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের আওতায় মশা নিয়ন্ত্রণেরও কাজ করা যাবে।’

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আরও বলেন, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রজনন বাড়ে। এটা তো সবার জানা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিপর্যায় থেকেও সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। আর ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে; তারা সেখানে কাজ করবে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০০। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৬১ জন। ডেঙ্গুর জীবাণুর বাহক এডিস মশা।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকাজের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকায় কোনো ধরনের জোড়াতালির মশা নিয়ন্ত্রণকাজ চললেও ঢাকার বাইরের মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদেরও তেমন কোনো সক্ষমতা নেই। এখন ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন চরমে উঠেছে; ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পাল্লা দিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। এ অবস্থায় এডিসের লাগাম টেনে ধরার কোনো সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নেই। এজন্য চলতি মৌসুমে দেশের এযাবৎকালের সবচেয়ে কঠিন সময় হতে পারে বলে মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদরা।

তাদের মতে, এ মুহূর্তে ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার প্রজনন উৎস চিহ্নিত করে ধ্বংস করা দরকার। কিন্তু সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান কার্যক্রম দিয়ে সেটা করা সম্ভব হবে না। কার্যকর তৎপরতা আরও না বাড়ালে এটা করা সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে সেটা পারবে না। এজন্য চলতি জুলাই এবং আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর আরও ভয়াবহ রূপ দেখতে হবে দেশবাসীকে।

গত চার অর্থবছরে ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণকাজের খরচ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মশা মারার নামে প্রতি বছরের খরচের গড় শতকোটি টাকার ওপরে। চলতি বছরেও মশা নিয়ন্ত্রণের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ঢাকায় মশক নিয়ন্ত্রণকাজ করছে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ডিএনসিসি ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিয়ন্ত্রণকাজ করছে। আওতাভুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও, মগবাজার, বাড্ডা, গুলশান-বনানী-বারিধারা, মিরপুর, উত্তরা-তুরাগ, ভাটারা, উত্তরখান ও দক্ষিণখানসহ ঢাকার উত্তরাঞ্চল। ওই এলাকার আয়তন ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। আর ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডেও মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আওতাভুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, শাহবাগ, পুরান ঢাকা, পল্টন, খিলগাঁও, সবুজবাগ, ডেমরা, দনিয়া এলাকাসহ ঢাকার দক্ষিণাঞ্চল। এ এলাকার আয়তন ১০৯ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার। আর দুই সিটির মশক নিধনের চার বছরের খরচের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিএনসিসি ২০১৯-২০ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণে খরচ করেছে ৭০ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ৫০ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৯ কোটি ৮৫ লাখ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০১ কোটি টাকা। আর ডিএসসিসি ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ করেছে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বার কীটতত্ত্ববিদ ড. জি এম সাইফুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অবৈজ্ঞানিক পন্থায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিটি করপোরেশন। কখনো তারা নিয়ম অনুসরণ করে কাজ করেনি। অন্যবারের চেয়ে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। একই সঙ্গে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থায় চলে গেছে, সরকারের বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।’

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সরকারকে মশা নিয়ন্ত্রণে চিন্তা করতে হবে। ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মশা বা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। নইলে ঢাকার বাইরে মশা বা ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামনের দিনে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে কাজ করতে হবে। এজন্য গবেষণাগার থাকা খুবই দরকার। সেখানে মশার প্রজনন উৎস ও মশার ভাইরাসের ধরন চিহ্নিত করা যায়। মশা এখন দেশের বড় সমস্যা; ভবিষ্যতেও মশার উপদ্রব থাকবে। এজন্য সামগ্রিকতা বিবেচনায় মশা নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দরকার।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। গবেষণার কাজে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি নিজস্ব জনবল বৃদ্ধি ও গবেষণাগার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামছুল কবির বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক দিক থেকে মশক নিয়ন্ত্রণকাজে ডিএসসিসির কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নিজস্ব গবেষণাগার ও পর্যাপ্তসংখ্যক কীটতত্ত্ববিদ না থাকা।’ তিনি বলেন, ডিএসসিসির পর্যাপ্ত পরিমাণ মশার ওষুধ রয়েছে। যেটা দিয়ে কয়েক বছর চলে যাবে। কিন্তু এসব ওষুধ দিয়ে তো ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা মারা সম্ভব হচ্ছে না।’


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *