রুপিতে বাণিজ্যে সম্ভাবনা রয়েছে, সতর্কও থাকতে হবে
রুপিতে বাণিজ্যে সম্ভাবনা রয়েছে, সতর্কও থাকতে হবে

বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশিরভাগ লেনদেনই করে থাকে ডলারের মাধ্যমে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের লেনদেনও হতো ডলারে। তবে ডলার সংকটে বাংলাদেশ এবং ভারত এবার ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে বাণিজ্য শুরু করল। আর এই লেনদেনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংককে। অন্যদিকে ভারতীয় পক্ষে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংককে। আপাতত রুপিতে শুরু হলেও উভয় দেশের বাণিজ্য ব্যবধান কমে এলে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকায়ও বাণিজ্য হবে বলে প্রত্যাশা।

কয়েকটি কারণে রুপিতে বাণিজ্য করার বিষয়টি সামনে এনেছে দুই দেশ। প্রথমত, ডলার-সংকটে রয়েছে উভয় দেশ। ফলে উভয় দেশ এতে লাভবান হবে। দ্বিতীয়ত, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের দুইবার মুদ্রা বিনিময় করার খরচ কমবে। তৃতীয়ত, লেনদেন নিষ্পত্তিতে সময় বাঁচবে। চতুর্থত, অন্য উদ্বৃত্ত মুদ্রা রুপিতে রূপান্তর করে লেনদেন নিষ্পত্তিতে ব্যবহার করা যাবে।

এসব বিষয় বিবেচনা করলে বাংলাদেশ এবং ভারতের বাণিজ্য লেনদেন ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে করার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলা চলে। তবে প্রথম দিকে রুপির লেনদেন সীমিত আকারেই হবে বলে মনে হয়। কারণ আমাদের কাছে রুপির মজুদ সীমিত। ভারত থেকে আমাদের আমদানি প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারতে আমাদের রপ্তানি মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের মতো।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে আমদানির মূল্য বাংলাদেশের নিজস্ব মুদ্রা টাকাতেও পরিশোধ করতে পারে। তবে তার পরিমাণ স্বল্পই হবে। কারণ, ভারত বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ টাকার মজুদ অন্য কোথাও কাজে লাগাতে পারবে না। তবে বিনিয়োগ এবং ঋণকে এখানে সম্পৃক্ত করলে টাকা ও রুপির বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত করা যাবে।

রুপিতে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উভয় দেশ সুবিধা পেলেও বাংলাদেশের জন্য কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে বিনিময় হার। এটা নির্ধারিত হতে হবে। এলসি খোলার সময় টাকা এবং রুপির বিনিময় হার কি হবে এবং সেটেলমেন্টের সময় বিনিময় হার কি হবে সে বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে দরকষাকষির একটা বিষয় থাকবে। তাই যারা এ বিষয়ে ডিল করবেন তাদের অবশ্যই অভিজ্ঞ হতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিনিময় হারের ওপর ব্যাংকগুলো অনেক লাভ করে থাকে। এটাকে বলা হয় এক্সচেঞ্জ আর্নিং। ভারতীয় ব্যাংকগুলো চেষ্টা করবে এখান থেকে যতটা সম্ভব মুনাফা করতে, তেমনি আমাদের ব্যাংকগুলোও চেষ্টা করবে। এ ছাড়া এখন যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত কিন্তু এর বাস্তবায়ন করবে ব্যাংক। তাই এখানে আমাদের ব্যাংকগুলোর দক্ষতা প্রয়োজন হবে।

বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা বর্তমানে অবমূল্যায়িত। ভবিষ্যতে শক্তিশালীও হতে পারে। তখন যেন ভারতীয় মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় হারের প্রতিফলন থাকে। বিনিময় হার নির্ধারণের সময় ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনোক্রমেই টাকার বিনিময় মূল্য কম না হয়। কারণ বিলিয়ন ডলারের লেনদেনে বিনিময় হার এক পয়সা কম হলেও সেটা বিরাট হয়ে দাঁড়ায়।

সারাবিশ্বই এখন ডলারকেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে বহুধাকেন্দ্রিক একটা বাণিজ্য ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার চিন্তা করছে। চীন চেষ্টা করছে তার দেশীয় মুদ্রা ইউয়ানকে বাণিজ্য মাধ্যম বানানোর জন্য। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনে বিনিময় মুদ্রার বহুধাকরণ ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য খুবই উপকারী। সে দিক থেকে বাংলাদেশের জন্যও এটা ভালো হতে পারে। তাই ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের লেনদেন ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে করার এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। তবে সতর্কও থাকতে হবে।

ড. সেলিম রায়হান: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *