আল বিদা মাহে রমজান
আল বিদা মাহে রমজান

তিরিশ রোজার সিয়াম শেষে/এলো খুশির ঈদ,  
জাগলো আকাশ পাহাড় নদী ভেঙ্গে চাঁদের নিদ। (কবি ফজল-এ-খোদা) ‘ঈদ’ মানে খুশি, আনন্দ, আর ফিতর মানে ভাঙা। অর্থাৎ মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর হলো রোজা ভাঙার উৎসব। তাহলে নামেই বোঝা যায়, এদিন কোনো সচরাচর আনন্দোৎসবের দিবস নয়, এ হলো রোজাদারের সাধনার সুফলের বহির্প্রকাশ, সিয়ামের মাসের বহুবিধ শিক্ষা প্রতিফলনের পহেলা মঞ্জিল; খুশি ও ইবাদতের সমন্বিত এক নির্মল আনন্দধারা। মাহে রমজান এখন বিদায়লগ্নে, দুই-তিনদিনের ব্যবধানে রোজা ভাঙার উৎসব।
মাহে রমজান মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে নিয়ে এসেছিল খোদাভীতি, সংযম, সাম্য,  মৈত্রী ও ভালোবাসার সওগাত। মাসব্যাপী এসব সাধনা ও অনুশীলনে প্রতিটি মুসলমান কাক্সিক্ষত নৈতিক চরিত্রগুলো অর্জন করেছেন বৈ কি? এখন থেকে ঈদের আনন্দধারায় তা সমাজে প্রদর্শনের বাস্তব মহড়া শুরু হবে, যা গোটা বছরের জন্য উম্মাহর পাথেয় হয়ে থাকবে… এ হলো ইসলামের দর্শন। তাই এই ঈদের আনন্দ নীতি-নৈতিকতা বিসর্জিত আনন্দ-উৎসব কিংবা উৎসবের নামে হৈ-হুল্লোড় ও বাড়াবাড়িকে সমর্থন করে না। অথচ এক শ্রেণির মানুষ ঈদকে ভোগের মহড়া, অপচয়, অপব্যয়ের প্রতীকে পরিণত করে তুলছে।
বস্তুত, এ ঈদ ত্যাগের, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আর উৎসর্গ করার, এ ঈদ ধনী-গরিব, শহুরে-গ্রামীণ সবার মাঝে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন রচনার। ঈদের দিনেও ইসলাম তাই গরিবদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারটি প্রাধান্য দিয়েছে। হাদীস শরীফে ঈদের নামাজের আগেই গরিবদের হক মিটিয়ে দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যাতে তাদের হাত পাততে না হয়। 
সত্যিকারের ঈদের আনন্দ রোজাদারের আমল বৃদ্ধি করে, নাজাতের পথকে করে সুগম। ঈদের (পূর্ব) রাতকে ইসলাম ঘোষণা করেছে পুরস্কার বিতরণের রজনী হিসেবে। ঈদুল ফিতর প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুলাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণনা করেন : যখন ঈদের সকাল নামে মহান আল্লাহ প্রতিটি দেশে দেশে ফেরেস্তা প্রেরণ করেন। তারা অবতরণ করে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা ডাকতে থাকেন। তাদের আহ্বান মানুষ ও জিন ব্যতীত আল্লাহর সব মাখলুকই শুনতে পায়। তারা বলেন : ওহে উম্মতে মুহাম্মাদী! বের হয়ে এসো অতি মর্যাদাবান প্রতিপালকের নিকট। তিনি অধিক পরিমাণে দান করে থাকেন। আর মারাত্মক অপরাধও ক্ষমা করেন। 
যখন লোকজন বেরিয়ে এসে ঈদগাহে সমবেত হয়, তখন আল্লাহ ফেরেশতাগণকে লক্ষ্য করে জানতে চান, শ্রমিক যখন তার নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করেন, তখন তার বিনিময় কী হতে পারে? ফেরেশতাগণ বলেন : ওহে আমাদের প্রভু, ওহে আমাদের  আল্লাহ! তার বিনিময় পরিপূর্ণভাবে দেওয়া উচিত। তখন আল্লাহ ঘোষণা করবেন : হে আমার ফেরেশতাকুল : আমি তোমাদের সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাদের রমজান মাসের সিয়াম সাধনার এবং রাতের ইবাদতের বিনিময়ে আমার সন্তুষ্টি এবং ক্ষমা দান করলাম। আল্লাহ বলেন : ওহে আমার বান্দাগণ! তোমরা আমার নিকট চেয়ে নাও।

আমি আমার সম্ভ্রমের কসম খেয়ে বলছি, তোমরা তোমাদের এ ঈদ সমাবেশে পরকালের জন্য যা কিছু চাইবে আমি তা দেব। আর দুনিয়ার ব্যাপারে যা চাইবে আমি  সে ব্যাপারেও বিবেচনা করব। (কেননা অনেক সময় দুনিয়ার ব্যাপারে এমন কিছু চাওয়া হয় যা কল্যাণকর নয়)। আমি আমার সম্মানের কসম খেয়ে বলছি, যতদিন তোমরা আমাকে সমীহ করে চলবে আমি তোমাদের ভুল-ভ্রান্তি চেপে যাব…। (বায়হাকী)
আজকের লাগামহীন ঈদের আনন্দে আমাদের অনেকে ঈদের ওপরে বর্ণিত ধর্মীয় গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা বেমালুম ভুলে থাকে। যার কারণে আমরা লক্ষ্য করছি, মুসলমানদের ঈদ ক্রমশ হয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ, উদ্দেশ্যহীন ও লক্ষ্যহীন। বস্তুত রমজান যেমন সাধনার মাস, এতে সিয়াম, কিয়ামসহ কঠিন ইবাদতসমূহের মাঝামাঝি রয়েছে ইফতার সেহরির আনন্দদায়ক মুহূর্তগুলো, তেমনি ঈদ-আনন্দও কিছু বিধিনিষেধে পরিপূর্ণ যা অনিয়মতান্ত্রিকতাকে নিরুৎসাহিত করে এক সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক দায়িত্ব-কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়।


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *