তথ্য ফাঁস ও নির্বাচনি কাঠামো জানতে চায় ইইউ
তথ্য ফাঁস ও নির্বাচনি কাঠামো জানতে চায় ইইউ

নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ভান্ডারে তথ্য সুরক্ষিত কি না, তা ইসির কাছে জানতে চেয়েছে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল। একই সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা, প্রস্তুতি ও আইনি কাঠামো সম্পর্কেও জানতে চান তারা। জবাবে ইসি (নির্বাচন কমিশন) তাদের বলেছে, সম্প্রতি তথ্য ফাঁসের খবর দেখে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তা সুরক্ষিত রয়েছে। নির্বাচন পদ্ধতি ও কমিশনের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তাদের অবহিত করা হয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা যত সংখ্যক পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায় তাতে ইসির আপত্তি নেই। ওই বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হয়নি। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসির সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করে ইইউ-এর প্রতিনিধিদল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা ও মো. আনিছুর রহমান এবং ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে এতে রিকার্ডো শেলেরির নেতৃত্বে ইইউ প্রতিনিধিদলে ছিলেন পাঁচজন। পরে তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একটি দল অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে তার কার্যালয়ে বৈঠক করে। আরেকটি দল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে। অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বৈঠকের সময় তার কার্যালয়ের বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুষ্ঠু ভোটের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা।

এদিকে ইইউ প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ছাড়াও জামায়াতের সঙ্গেও বৈঠক করবে। ১৫ জুলাই বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের সময় দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর রিকার্ডো শেলেরি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন-পূর্ববর্তী অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য এসেছি। দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থানকালে এ দেশের নির্বাচন-পূর্ববর্তী অবস্থা জানার চেষ্টা করব। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে প্রতিবেদন দেব। তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না। এ সময় তার পাশে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল থাকলেও তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বৈঠকের বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ইইউ-এর প্রতিনিধিদলটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে ইসির কাছে জানতে চেয়েছে। বিশেষ করে ভোটার, ভোটকেন্দ্র, পর্যবেক্ষক, সিসি ক্যামেরা নিয়ে তারা জানতে চেয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম কি না, এ বিষয়েও জানতে চেয়েছে। ইসি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেছে। ইইউ-এর প্রতিনিধিদল সন্তুষ্ট।

অতিরিক্ত সচিব বলেন, পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে কী কী প্রস্তুতি নিতে হয়, ইসি কী করবে, তা জানতে চেয়েছে ইইউ-এর প্রতিনিধিদল। কমিশন বলেছে, তারা যতসংখ্যক ইচ্ছা পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে, এর কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আবেদনের জন্য সময়সীমা আছে কি না, তা জানতে চেয়েছে তারা। ইসি বলেছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন এলে সুবিধা হয়। কারণ, আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের বিষয়ও রয়েছে। তারা (ইইউ) যদি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠায়, যতসংখ্যক চায় পাঠাক, কোনো আপত্তি নেই নির্বাচন কমিশনের।

এক প্রশ্নের জবাবে ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেন, বর্তমান কমিশনের অধীন এখন পর্যন্ত ৯১১টি নির্বাচন হয়েছে। ওইসব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এতে সন্তোষ রয়েছে ইইউ-এর প্রতিনিধিদল। পরিবেশ নিয়ে এখন পর্যন্ত ইইউ-এর প্রতিনিধিদল সন্তুষ্ট। তবে তারা আরও আলোচনা করবে। ১৮ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে তারা আবার ইসির কারিগরি দলের সঙ্গে বসবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ইসির বিষয় নয়। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে আনার বিষয়ে ইইউ-এর প্রতিনিধিদল কিছু জানতে চায়নি। নির্বাচনকালীন সরকার ও কোনো দলকে ভোটে আনার বিষয় বৈঠকের আলোচনায় আসেনি। অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ইসির সক্ষমতা নিয়ে ইইউ-এর প্রতিনিধিদল সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি কিছুই প্রকাশ করেনি। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কি না, তা নিয়েও তারা জানতে চায়নি।

এদিকে বৈঠক সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বিপুল নাগরিকের তথ্য ফাঁসের খবর নিয়ে আলোচনা তোলে ইইউ-এর প্রতিনিধিদল। জবাবে সিইসি তাদের বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পরই তথ্যভান্ডার পরীক্ষা করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ভান্ডার থেকে কারও তথ্য ফাঁস হয়নি। তথ্য সুরক্ষিত ও নিরাপদ আছে। নির্বাচনি কাঠামো সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে সিইসি সম্প্রতি আরপিও সংশোধনের বিষয়টি তাদের জানান। আগামী নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়েও অবহিত করেন। বৈঠকের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে সিইসি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে ভালো হয়। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার বিষয়টি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরশীল। এটি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত নয়। বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধিদলও সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে আলোচনা তোলেনি।

ইইউ বৈঠক চলাকালে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বিক্ষোভ : মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে তার কার্যালয়ে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধিদল। বৈঠক চলাকালে এবং বৈঠক শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। বিক্ষোভে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ দিতে ইইউ প্রতিনিধিদলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন তারা। বিক্ষোভে তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, নো মোর হাসিনা, উই ওয়ান্ট কেয়ারটেকার, নো মোর হাসিনা’ উই ওয়ান্ট ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন’, ডিএসএ ইজ এ ব্ল্যাক ল’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। এছাড়া কাগজে লেখা বিভিন্ন স্লোগান প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল প্রমুখ। প্রতিনিধিদলটি পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট ত্যাগ করে।

পরে বৈঠকের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তারা নির্বাচনি আইন সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলেছেন। নির্বাচনকালীন আরপিও আইন, ফৌজদারি আইন ও দেওয়ানি আইন এবং নাগরিকদের অধিকারের যেসব আইন আছে, সেগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। জবাবে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনগুলো কী আছে না আছে, সেগুলো বলেছি। সূত্র জানায়, বৈঠকে সুশাসন, মানবাধিকার, দেশের বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন নিয়ে ইইউ দল আলোচনা করে। এতে অ্যাটর্নি জেনারেল ছাড়াও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী অংশ নেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ইইউ-এর আগ্রহ নেই-ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম : মঙ্গলবার সকালে গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাসে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করে ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের প্রতিনিধিদল। পরে সংগঠনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবেদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো আগ্রহ নেই। এ বিষয়ে তারা একটি প্রশ্নও করেনি। সংবিধানে নেই এমন কোনো কথা বলেননি তারা। ইভিএম থেকে সরে আসায় ইইউ বিস্ময় প্রকাশ করেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে কি না জানতে চাইলে আবেদ আলী বলেন, তারা আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের মাধ্যমে আসার কোনো সুযোগ আছে কি না, তা তারা জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, অবশ্যই আসা যাবে। কারণ, আমরা বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়ে আসি। আপনারা আমাদের মাধ্যমে আসতে পারবেন। এ কথাটা সুনির্দিষ্টভাবে তারা উল্লেখ করেছেন। আমরা আশা রাখছি, তারা আসবেন।

এ সময় ফোরামের উপদেষ্টা ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, ডুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান ও বুয়েটের উপ-উপাচার্য ড. আব্দুল জব্বার খান উপস্থিত ছিলেন।


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *